জীবন-জীবিকা দুটোই বাঁচাতে হবে
রায়হান আহমেদ তপাদার
দেশের মানুষের খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলার জন্য কৃষক সমাজ আবহমানকাল ধরেই নিরলসভাবে উৎপাদনের সঙ্গে নিজেদের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রেখেছেন। বছর বছর নিজের ক্ষতির দিকটা উপেক্ষা করেও তারা উৎপাদনের মাঠে অবস্থান করে দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে চলেছেন। এ কারণে এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ খেয়ে- পরে বেঁচে আছে।আমাদের কৃষকরা কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। অথচ কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বরাবরই বঞ্চিত। বিকল্প কর্মসংস্থান নেই বলেই নিরুপায় কৃষকরা আধপেটা খাবার খেয়ে দেশবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। মাঠের ফসলের মূল্য আর ভোক্তাদের যে মূল্য দিতে হয়, তার সঙ্গে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টিতে যুক্ত মধ্যস্বত্ব- ভোগীচক্র, যারা কৃষিপণ্য থেকে বিনাশ্রমে নানা উপায়ে মুনাফা লাভ করলেও উৎপাদক কৃষকেরা থাকে বঞ্চিত। শীত, গরম, বর্ষা গায়ে নিয়ে কৃষক অত্যধিক কায়িক পরিশ্রম করেও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। অনিয়ম-অতিপরিশ্রমে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে নানা মরণব্যাধির মুখে পড়তে হয় কৃষকদের। ফসলের মাঠে কর্মরত কৃষকদের বজ্রপাতে প্রাণ হারানোর ঘটনাও প্রায়ই ঘটে। কৃষকদের জীবিকা যে ঝুঁকিমুক্ত সেটা কিন্তু বলা যাবে না। তাদের জীবনও জীবিকার তাগিদে নিরাপদ নয়। এখন যে দুঃসময়টা যাচ্ছে তা কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী। এই সমস্যাটা আমাদের সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। এই যে সময় যাচ্ছে, এ সময়টায় নিজেকে একটু বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে। সমাজ থেকে একটু দূরে রাখতে হবে। এটার মানে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করা নয়।আমি ঘরে বসেও গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্বের খবর পাচ্ছি, সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছি।
বিশ্ব মানবতা এখন নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মানব সভ্যতা যুদ্ধে নেমেছে অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে। যুদ্ধ পরিস্থিতি যেখানে বিরাজমান সেখানে বিশ্বব্যাপী সম্মিলিতভাবেই এই যুদ্ধজয়ের সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য বিশ্ব নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা দরকার।যে নেটওয়ার্কটি আছে সেটি হচ্ছে জাতিসংঘ বিশ্ব মানবের নিরাপত্তার জন্যই জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে। জাতিসংঘ গড়ে ওঠার পর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাতিসংঘের মূল শক্তি নিরাপত্তা পরিষদ আগে এক হয়ে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এখন সময় এসেছে পৃথিবীর সব দেশ একমত হয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে। প্রণোদনা দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠান, যানবাহন বন্ধ করা হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী প্রচেষ্টা চলছে। কোথাও কোথাও লকডাউন করা হচ্ছে। নানাভাবেই চেষ্টা চলছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বাস্তবতা অনুসারে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। এ জন্য আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংগঠনগুলো এগিয়ে আসছে। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষও করোনা সম্পর্কে অবহিত। তারা বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যাদের প্রতিদিনই আয় করে খাদ্য সংস্থান করতে হয়। এখন সব কিছু স্থবির। আয় হচ্ছে না। তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাই অনেকে ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। ত্রাণের জন্য ছুটছে। তার মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।এ অবস্থায় আমাদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা দরকার। জনগণকে ঘরে রাখার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা দরকার, সেটা নিতে হবে।
এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যের সংস্থান করা, যে যেখানে আছে সেখানেই খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এসেছে। এখন সবার মধ্যে সমন্বয়টা দরকার। সমন্বয় করে যদি পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে আমার মনে হয়, আমরা মানুষকে ঘরে আবদ্ধ রাখতে পারব। লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব, বিশ্বের কোনো দেশই শতভাগ মানুষকে ঘরে রাখতে পারছে না। নানা কারণে মানুষ বেরিয়ে আসছে।
উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ যেমন জাপান, কোরিয়া কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সবটাই কিনে নেয়। পরে আবার তা কম দামে বিক্রি করে। জাপানের জিডিপিতে কৃষির অবদান দুই ভাগ কিন্তু ভর্তুকি আরো বেশি। আমি মনে করি, আমাদের দেশেও কৃষি উপকরণে সহায়তা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এটা করা গেলে সব ধরনের কৃষকের কাছে সরকারের সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো যাবে। ফলে কম মূল্যে বিক্রির পরও কৃষকের মুনাফা কমবে না। ধান তো বিক্রি করতে না পারলে রেখে দেওয়া যায়। কিন্তু সেসব কৃষিপণ্য পচনশীল বা রাখি করে রাখা যায় না যেমন শাকসবজি, ফলমূল। যশোর, ঝিনাইদহ, রংপুর অঞ্চলে রবি বা শীত মৌসুমে মুলা-কপি বা অন্যান্য অনেক শাকসবজির দাম ১০ টাকায় এক মণ হয়ে যায়। এমনও হয় বিক্রি না হওয়ায় কৃষক নিরুপায় হয়ে গরু-ছাগল দিয়ে খাইয়ে দেন। অথচ সেই শাকসবজি ঢাকা বা মহানগরগুলোতে ৪০ টাকার অধিক কেজি দরে বিক্রি হয়। ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজারজাতকরণের দুর্বল কাঠামোর কারণে কৃষক এর ফল ভোগ করতে পারেন না। তাদের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে যায় অধরা।
ভাবতে অবাক লাগে, এ দেশে এক কেজি ধান বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন ২৬ টাকা। সেখানে পানির প্রাচুর্যের দেশে হাফ লিটার পানি বিক্রি করে বড় শিল্পপতিরা পাচ্ছেন ১৫ টাকা! সার্বিক পরিস্থিতি থেকে উপলব্ধি করতে পারছি যে, আমাদের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হবে। এর জন্য কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দেশে বীজ বপন থেকে শুরু করে বাজারজাত করণের প্রতি স্তরে কৃষক পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। এমনকি বিমার ব্যবস্থাও রয়েছে। বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষক তার উৎপাদিত ধান ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন এটাই সবার প্রত্যাশা। আমাদের মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু কৃষিকে কত গুরুত্ব দিতেন, তা ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণে ফুটে উঠেছে। তিনি বিশাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয় জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিন গুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণও করতে পারি, তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না। আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করেন, যারা প্যান্ট পরা, কাপড় পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই জমিতে যেতে হবে, ডাবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহিদদের কথা স্মরণ করে ডাবল ফসল করতে হবে। যদি ডাবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ হবে না। বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণটি আজ যথাযথভাবে প্রমাণিত।
কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে দেখা যায়, ইতিমধ্যেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে ৪ কোটিতে নেমে এসেছে। বলতে হবে এটাও বড় মাপের অর্জন। কারণ এমন এক সময় ছিল যখন এ দেশের শ্রমজীবি মানুষের কর্মক্ষেত্র ছিল খুবই সীমিত। সময়ের ব্যবধানে সে ধারার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বাস্তব এ অবস্থার নিরীখে সরকারও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। যদি দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে প্রবাসী রেমিট্যান্সের পরিমাণ যেমন একদিকে বেড়ে যাবে, অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতিও মজবুত হবে। করোনাপূর্ব বিশ্ব আর করোনা-পরবর্তী বিশ্ব এক থাকবে না। লকডাউন, বন্ধ উঠে গেলে পরবর্তী সময়ে কী হবে তা এখনই ভাবতে হবে। জীবন বাঁচিয়ে রাখতে জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। জীবিকা ছাড়া জীবনকে সচল রাখা যাবে না। তাই জীবন ও জীবিকাকে একইভাবে দেখতে হবে। এখন থেকে সেই পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থভাবে বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। তিনি বলেছেন, এক ইঞ্চি ভূমিও অনাবাদী রাখবেন না। কৃষকদের তিনি প্রণোদনা দিয়েছেন। কৃষক যেন সেই প্রণোদনা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক যেন তার কার্যক্রম সচল রাখতে পারে তার দিকে নজর রাখতে হবে। খাদ্যের সংস্থানকে কোনোভাবেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যাবে না। সে জন্য খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য বিপণন ব্যবস্থাটি সব সময় নিষ্কণ্টক রাখা প্রয়োজন। করোনা সংক্রমণের দিকে যেভাবে প্রতি মুহূর্তে নজর রাখছি, একই ভাবে খাদ্য পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে হবে।
করোনা-পরবর্তী খাদ্য পরিস্থিতির বিষয়টিও সুপরি- কল্পিতভাবে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। বলা সঙ্গত, এখন ধানকাটা নিয়ে কোনো সংকট নেই। বরং পাহাড়ি ঢল নামার আগেই কৃষকের ঘরে ধান উঠবে, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের যে চিত্র তুলে ধারা হচ্ছে, তা সত্যিই ভয়াবহ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই এ বিষয়ে দেশের মানুষকে সতর্ক করছেন এবং এরই মধ্যে কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরা ৫ শতাংশ সুদে এ ঋণ নিতে পারবেন। খাদ্য সংকট থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে এই প্রণোদনার অর্থ যথাসময়ে কৃষকের হাতে পৌঁছতে হবে।তা নিয়ে নয়ছয়ের কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, এই দুঃসময়ে দেশের স্বার্থে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে শক্তভাবে। এবং দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।