ফিলিস্তিনে-ইসরাইলী বর্বর হামলা:প্রয়োজন ঐক্য এবং প্রতিরোধ
আমিনুল হক চুন্নু
আধুনিক বিশ্বে বছরের পর বছর মানুষ হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়া একমাত্র রাষ্ট্র হচ্ছে ইসরাইল।সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেলেও পশ্চিমা দুনিয়া ইসরায়েলকে সন্তানের মতোই লালন পালন করছে।তবে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ইসরাইলের এমন বর্বরতাকে সমর্থন করতে পারে না।
ফিলিস্তিন এখন রক্তাক্ত প্রান্তর-
মৃত্যু চিনতাম না;যদি না রিফিউজি ক্যাম্পে বোমা
বর্ষন না দেখতাম।
কাঁটা হাত,পা,মুন্ডু,কবন্ধে
গর্ত ভরাট,মুখ নেই
শুধু কান্না মুছে যাওয়ার ছাপ রয়ে গেছে।
ফিলিস্তিন কবি রেমি কানজির এর কবিতার বর্ণনার চেয়েও নৃশংস চলমান ইসরাইলী আক্রমন।ফিলিস্তিনে গত ১৩ মে থেকে যেভাবে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে,আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম একে স্মরণকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী ধ্বংসযজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছে।বিশ্বব্যাপী মৃসলমানরা যখন করোনার তান্ডবের মাঝে সীমিত পরিসরে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, ফিলিস্তিনি মুসলমানরা তখন আগ্রাসী ইসরাইলের কামান আর বিমান থেকে বোমাবৃষ্টির ভয়ে প্রাণ নিয়ে এদিক-সেদিক দৌঁড়াচ্ছে। বিশ্বের অন্য মুসলমানরা যখন পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করছেন, ফিলিস্তিনরা তখন মৃত স্বজনের লাশ দাফন কিংবা বোমা-গুলিতে ক্ষতবিক্ষত স্বজনদের প্রাণ বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
ফিলিস্তিন এখন এক রক্তাক্ত প্রান্তর।উপর থেকে পড়ছে বোমা,চারদিক থেকে আসছে গোলা, আকাশে ১৬০টি জঙ্গি বিমান ঝাঁক বেঁধে হামলায় নেমেছে আর স্থলপথে ট্যাংক, কামান, আর্টিলারি ও গানবোট থেকে হচ্ছে হামলা।ইসরাইলের নিক্ষিপ্ত গোলা ও বোমায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনের রাতের আকাশ জ্বলে উঠছে।বলা হচ্ছে,২০০০সালের পরে আকাশ পথে এত হি¯্র আক্রমণ আর হয়নি।আল-আকসা মসজিদে শবে-কদরের নামাজ পড়তে জড়ো হয়েছিলেন ফিলিস্তিনিরা,নামাজরত অবস্থায় হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী।এর প্রতিবাদে জুমাতুল বিদার নামাজে শরিক হন হাজার হাজার ফিলিস্তিন মুসলমান।গত ১৪ মে থেকে ইসরাইলি সন্ত্রাসী হামলায় ১৮ মে মঙ্গলবার পর্যন্ত ২১২জন ফিলিস্তিনির নির্মম মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৬১টি শিশু ও ৩৬জন নারী রয়েছেন। ঈদের দিনও ইসরাইলি হামলা থেকে রেহাই পায়নি ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ ও শিশুরা।ঈদ উপলক্ষে ভাই-বোনদের একটি পরিবার একত্রিত হয়েছিল কিন্তু ইসরাইলি বোমা ঈদের পোষাক পরা ফিলিলিস্তিনি শিশুদের প্রাণ কেড়ে নেয়। তিনতলা একটি ভবন নিমিষেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। গাজা উপত্যকায় ৮টি শরনার্থী শিবিরের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম শিবিরের নাম শাচি, এখানে ৮৫হাজার ফিলিস্তিনি শরনার্থীর বাস, এ শিবিরে হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়েছে। একজন ফিলিস্তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের জন্য রাতগুলো ভয়ংকর, আমার বাড়ি যে কোন সময় কবরে পরিণত হতে পারে’। হামলায় আহত মানুষ কাতরাচ্ছে, শিশুরা কাতরাচ্ছে। এ পর্যন্ত সহ¯্রাধিক নারী-পুরুষ, শিশু আহত হয়েছে। ইসরাইল এ পর্যন্ত ৮০০ফিলিস্তিনি স্থাপনায় হামলা করেছে। ইতোমধ্যে ১৫হাজার ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।
তবে ইসরাইলের জন্য ফিলিস্তিনি হত্যার অজুহাত লাগে না।প্রতিটি রোজার মাসে ইসরাইল ফিলিস্তিনি হত্যা করে, এটা তাদের বছরওয়ারী উৎসব। তাই তাঁরা ভুল বলেন- যাঁরা বলেন যে, হামাস রকেট ছুড়েছে বলে ইসরাইল মিসাইল মারতেই পারে । ইসরাইল তার অবৈধ বসতি বিস্তার এক মুহুর্তের জন্যও থামায়নি। ইসরাইল তার সীমান্তকে এদিকে নীল নদ, ওদিকে উজান নদী, আরেক দিকে ফোরাত নদী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার মহা পরিকল্পনাও কখনো লুকায়নি। ইরাক, মিশর, সৌদি আরব, জর্ডান ও সিরীয় ভূখন্ড দখল করে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্টা করাই তাদের নিরুপায় পরিকল্পনা।নিরুপায়,কারণ আরব রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙ্গে না ফেললে ইসরাইল কখনো নিরাপদ হবে না।অস্তিত্ব টেকাতে ইসরাইলকে বর্বর হতেই হবে। তারা ভাল করেই জানে যে, আরবকে বিভক্ত করে শাসন করার চিরকালীন নিশ্চয়তা নেই। গত কয়েক মাসে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। একদিকে চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্কের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে সৌদি জোট ও মিশর। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পতন তো দৃশ্যমান, ট্রাম্পের কল্যাণে রাজনৈতিক ভাবেও দেশটা ভয়ানক বিভক্ত।দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র অটোমান সা¤্রাজ্যের আরব অঞ্চল দখল করে নেয়।অধিকৃত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন এবং সদ্য আবিস্কৃত তেল খনির বখরা এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ধমনি সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণের জন্য।
দুটি পাহারাদার নিযুক্ত করে তারা প্রায় একই মঞ্চে জন্ম নেয় সৌদি আরব ও ইসরাইল। এই ঔপনিবেশিক যমজের জুটি ভাঙ্গা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির প্রধান শর্ত। ইতোমধ্যে ফাটল দৃশ্যমান।মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের আগ্রাসনকে আত্মরক্ষার অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, মুসলিম উম্মার নেতারা তখন তাদের ইহুদি-নাসারা প্রভুদের খুশি রাখতে মুখে কুলুপ এটে বসে থাকেন। প্রসঙ্গ উল্লেখ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাজায় বর্বর ইসরাইলি হামলাকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসাবে অভিহিত এবং তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে তিনি চিঠিও লিখেছেন এবং তাদের সংগ্রামে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ আরব দেশ নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ হলেও একটি সেক্যুলার দেশ, তবু মানবতা যেখানেই নিপীড়িত হয়েছে সেখানেই বাংলাদেশ তার সাধ্যমত প্রতিবাদ জানিয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর দেশটির সামরিক জান্তা বর্বর অত্যাচার চালিয়ে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশ একটি বড় ও ধনী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যাটির সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের মতো রোহিঙ্গারাও মুসলমান অথচ এবার তাদের উপর বর্বর গণহত্যা চলতে থাকার সময়ে একটি মুসলিম দেশও (আরব দেশ) প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে আসেনি। আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত ও চীন এই দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের উপরে অত্যাচার নিবারণে টু শব্দটি করেনি। বাংলাদেশে ১৯৭১সালে পাকিস্তনিরা ৩০লাখ নর-নারী ও শিশু হত্যা করে , তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল মুসলমান কিন্তু ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ছাড়া আর কোন মুসলিম বা আরব দেশ এর প্রতিবাদ জানায়নি। বরং তখনকার সৌদি আরব তো এই গণহত্যায় পাকিস্তানকে সমর্থন ও সাহায্য জুগিয়েছে।
অতীতের এই ইতিহাসটা টানলাম এ জন্য যে, আজ যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতা চলছে তখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো প্রকৃতপক্ষে নীরব। তাদের মধ্যে ইরান ও তুরস্ক এই বর্বরতার প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা মুসলিম দেশ বটে কিন্তু আরব দেশ নয়। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার অস্ট্রিয়া সফর বাতিল করেছেন কারণ অস্ট্রিয়ার সরকারি ভবনে ইসরাইলি পতাকা তোলা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্বে জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্টার দাবীও পূনর্ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তো ইসরাইলকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন। ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলি নিপীড়নে তুরস্ক চুপ থাকবে না বলে হুমকি দিয়েছেন। তাদের বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম মুসলিম প্রধান দেশ তুরস্ক।ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ তার কবিতায় লিখেছেন‘বিষন্ন আমার দেশ আবার ফিরে আসবে।
উদিত হবে নতুন সকাল’।
দাবির তাতোর লিখেছেন-
প্রতিরোধ করো আমার জনগণ
ওদের প্রতিরোধ করো’।
মুক্ত ফিলিস্তিন পৃথিবীর বুকে একদিন দাঁড়াবেই, যার রাজধানী হবে জেরুজালেম।
তাছাড়া প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) মিরাজের রাতে মসজিতুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে ভ্রমন করেন যা ‘ইসরা’ বা রাতের ভ্রমন হিসাবে পবিত্র কোরআনে এসেছে। প্রিয় নবী (সা:) মিরাজ গমনের সময় সকল নবী-রাসুলদের নিয়ে এই মসজিদে নামাজ পড়েছেন।নামাজে তিনি ইমামতি করেন।এ জন্য মহানবী (সা:) ইমামূল আম্বিয়া, সাইয়্যিদুল মুরসালিন বা সব নবী রাসুলদের সর্দার হিসাবে স্বীকৃত। জেরুজালেমের এ এলাকা বহু নবী-রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত, এখানে তাদের কবর রয়েছে ফলে প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে এ পবিত্র ভূমির প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান রয়েছে।
ফিলিস্তিনের ঐতিহ্য বহু পুরনো, প্রায় ১০ হাজার বছরেরও অধিক যে মুসলিম জাতি দ্বারা অধ্যুষিত ছিল ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে গঠিত ফিলিস্তিন অঞ্চল সেই অঞ্চলটি আজ ইসরাইলি হামলার শিকারে পরিণত হয়ে রক্তাক্ত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই ফিলিস্তিনেই রয়েছে মুসলিমদের পবিত্র মসজিদ ‘আল আকসা’। জেরুজালেম মুসলিম, খৃষ্টিয়ান ও ইহুদিদের জন্য পবিত্র এক ভূমি। এই পবিত্র ভূমি নিয়ে এ তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ চলেই আসছিল দীর্ঘ দিন ধরে, কিন্তু তার পরও ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দা ছিলেন ঐ মুসলিম সম্প্রদায়।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর উসমানীয় সা¤্রাজ্যের দক্ষিণ সিরিয়া অংশ থেকে আলাদা করা ফিলিস্তিন বৃটিশ প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত একটি ভৌগলিক অঞ্চল ছিল।১৯২০থেকে ১৯৪৮খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বৃটিশ বেসামরিক প্রশাসন ফিলিস্তিন পরিচালনা করে। বৃটিশরা ১৯২২সালের জুন মাসে বিলুপ্ত লীগ অব নেশনস থেকে ফিলিস্তিনের জন্য কর্তৃত্ব লাভ করে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে অভ্যুদয়ের পূর্বে অন্তর্বর্তীকালিন সময়ের জন্য ফিলিস্তিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বৃটিশ সরকারের অভিবাকত্বের অধীন করা হয়। লীগ অব নেশনস এর গঠনতন্ত্রের ২২নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বৃটেনকে এই কর্তৃত্ব দেয়া হয়। লীগ অব নেশনস কর্র্তৃক বৃটেনকে কর্র্তৃত্ব প্রদত্ত দুটি অঞ্চল ছিল। একটি জর্ডান নদীর পশ্চিম অংশ যা ফিলিস্তিন বলে পরিচিত ছিল, এই অংশ ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সরাসরি বৃটিশ শাসনের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আরেকটি অংশ ছিল পূর্ব তীরের ট্রান্সজর্ডান যা অধিক স্বায়ত্বশাসিত হিসাবে পরিচালিত হচ্ছিল। ট্রান্সজর্ডান ১৯৪৬সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮সালে নাম বদলে জর্ডান রাখা হয় কিন্তু ফিলিস্তিনের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটেন।
তখন ১৯০৫ থেকে ১৯১৪সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার কিন্তু ১৯১৪সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯১৮সাল পর্যন্ত ব্রিটিশের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ২০হাজারে উন্নীত হয়। এরপর প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীদের ধরে এনে জড়ো করা শুরু হলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৩সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ৩৫হাজারে পৌঁছে যায়। ১৯৩১ সালে ইহুদিদের এই সংখ্যা প্রায় ৫গুন বৃদ্ধি পেয়ে ১লাখ ৮০হাজারে পৌঁছায়। এভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৮সালে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ৬লাখে উন্নীত হয়। ১৯১৮সালে বৃটেনের সহযোগিতায় গুপ্ত ইহুদি সন্ত্রাসী বাহিনী ‘হাগানাহ’ গঠিত হয়। এ বাহিনী ইহুদিবাদীদের রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে বৃটিশদের পর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্টিত জাতিসংঘ। ১৯৪৭সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। তবে বলে রাখা ভালো যে, মিশরের নাসের এবং ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় থাকাকালে যেভাবে ইসরাইলের বর্বর আধিপত্য থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন, সে ধরণের চেষ্টা চালানোর মতো কোন নেতা মধ্যপ্রাচ্যে এখন নেই। মধ্যপ্রাচ্যে সাদ্দাম হোসেন ইসরাইলের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠাতেই পশ্চিমা শক্তি ছলে বলে কৌশলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে হত্যা করে।বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অটোমান সা¤্রাজ্যের পতন ঘটলে সেখানে বৃটিশ শাসনের সূযোগে পূর্ব ইউরোপ থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদি এই ভূখন্ডে বসতি গড়ে তোলে। ঐ সময় ইহুদি সম্প্রদায়ের জাতিগত স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে ১৯১৭ সালে তৎকালিন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলকোর ডিক্লারেশন নামক ঐ ঘোষণাই কাল হয়ে দাঁড়াল মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য।আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলো ইহুদি গোষ্টি, যার কারণে পরবর্তীতে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। ১৯২০, ১৯২১ এবং ১৯৩৯সালে সংঘটিত সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কিন্তু বেনিয়া বৃটিশ ভারতের হিন্দু-মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কাশ্মীর রাষ্ট্রকে নিয়ে যে অসৎ খেলা খেলেছিল ১৯৪৮সালের মে মাসে ফিলিস্তিনকে নিয়ে একই খেলা খেললো। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের জনগণের দাবীকে উপেক্ষা করে ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়ে কার্যত এই দুই ধর্মীয় গোষ্টির বিবাদকে তারা স্থায়ী রূপ দিল। যার করুণ পরিণতি মুসলিমরা নিজ বাসভূমে নিজেরাই আজ বাস্তুহারা।
হিটলার ইহুদিদের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল, যেভাবে ইহুদিদের বাস্তুহারা করেছিল সেই বর্বরতার চেয়ে ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের বর্তমান বর্বরতা কম কিছু নয়, আর তাকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আখ্যা দিচ্ছেন ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার। গত শতকে হিটলার তাহলে জার্মানীর আত্মরক্ষার অধিকার রক্ষার জন্য লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন? ফিলিস্তিনিদের মুক্তি এবং স্বাধীনতা অর্জন মার্কিন মধ্যস্থতা দ্বারা কোন দিন সম্ভব হবে না।আবার একটু অতীতের কথায় ফিরে যাই। বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে , ১৯৭৩ সালের কথা। ইসরাইল সেবারেও ফিলিস্তিনি আরবদের উপর হামলা চালিয়েছে, সঙ্গে লিবিয়ার উপরও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র ভাষায় এই হামলার নিন্দা জানান। তিনি বলেন,‘ আক্রান্তরা কোন ধর্মের লোক তা আমার কাছে বিবেচ্য নয় আমার মতে আক্রান্ত মানবতা’।ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর একটি স্পষ্ট ভাষণ সম্ভবত ভারতের তৎকালীন প্রধানন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধিকেও প্রভাবিত করেছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মিীরিদের জাতীয় নেতা এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহকে মুক্তি দিয়ে তাকে আবার মুখ্য মন্ত্রী পদে বসতে দেন। কাশ্মিীরে মোতায়েন ভারতীয় সৈন্যদের তৎপরতা বন্ধ হয়। অনেকে বলেন, শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে তার মধ্যস্থতায় এতদিনে কাশ্মিীর সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়ে যেত।
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলজেরিয়ার জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের দেখা হয় তখন বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিনি নেতাকে বলেছিলেন, পটকা নিয়ে বন্ধুকের সঙ্গে লড়াই করা যায় না, আপনাদের আসল মুক্তি জনগণের ঐক্য এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে জনগনের ঐক্যের সামনে আনবিক বোমাও কিছু নয়। দূর্ভাগ্যবশত আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই। ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ করার আগে এই ঐক্য গড়ে তুলুন। আর একটি কথা, দূর্বল অবস্থানে থেকে কখনো শত্রুর সঙ্গে আপস করতে যাবেন না। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াসির আরাফাতের এই ঐতিহাসিক বৈঠকের বিবরণ আলজেরিয়ার আরবি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ পত্রে বড় করে ছাপা হয়েছিল।
২০০৮সালের জানুয়ারি মাসে জল, স্থল ও আকাশ পথে ত্রিমুখী হামলা চালিয়ে ইসরাইল গাজার ১৪লক্ষ ফিলিস্তিনিকে অবরুদ্ধ করে যে নারকীয় তান্ডব চালিয়েছিল সেই হত্যাযজ্ঞে একইভাবে পশ্চিমা শাসক গোষ্টি আজকের মতই নীরব সমর্থন জুগিয়েছে। এক সময়ের ফিলিস্তিন জনগণের অবিসাংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন প্যালেষ্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও’র মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক দেন দরবার হলেও সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই জায়গাতে আটকে আছে। তাছাড়া উক্ত কর্মকান্ডের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ‘নাভি পিল্লাই’ এক সময়ে প্রচন্ড ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন যে, ধনী দেশগুলি চায় না বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ দেশসমুহে শান্তি আসুক, সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হোক, আর সে কারণেই যুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে না দুনিয়ায়।
তবে দু:খজনক হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাবের কারণে এখনো মসজিদুল আকসা উদ্ধার করা যায় নি। ইরানের মরহুম ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন যে, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব তথা রাষ্ট্রগুলো যদি এক হয় তবে লড়াইয়ের প্রয়োজন নেই। প্রত্যেক মুসলমান যদি এক বালতি পানি ঢেলে দেয় তাহলেই ইসরাইল নামক ইহুদি রাষ্ট্র তলিয়ে যাবে। তবে শুধু সম্ভব হবে নিজস্ব ঐক্য ও সংহতি দ্বারা। আরব শাসকদের সাঙ্গে নয় বরং আরব জনগণের সাথে ফিলিস্তিনের সুদৃঢ় ঐক্য এবং সম্মিলিত প্রতিরোধই তাদের জয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত করবে।
দীর্ঘ সময় ধরেই ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অনেক বর্বরতা চালানো হয়েছে। হামাসকে নির্মুলের কথা বলে ২০১৪ সালেও নেতানিয়াহু সাত সপ্তাহ ব্যাপী আগ্রাসন চালিয়েছিল তাতে জীবন গিয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার মানুষের। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করা যায়নি, হামাসকেও নির্মুল করা যায়নি। এতে, শুধু হিংসাই বাড়ছে। সারা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের মতো আমরাও আশা করি ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলি আগ্রাসনের অবসান হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিশ্ব নের্তৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ,গবেষক ও প্রাবন্ধিক।প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ,সিলেট। পিএইচ,ডি ফেলো।