বঙ্গবন্ধু হত্যায় দেশি বিদেশি চক্র

পঙ্কজ ভট্টাচার্য

 

দৈনিক সমকাল কর্তৃপক্ষ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনি দেশি-বিদেশি কুশীলবদের ভূমিকাসহ প্রকাশের প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু আমার মতো সীমিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে তাদের কাঙ্ক্ষিত অনুসন্ধানী তথ্য-উপাত্ত হাজির করার ক্ষেত্রে অক্ষমতা-সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থেকেই মর্মন্তুদ এই হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর কার্যকারণ তুলে ধরছি।

এক. বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি তখন প্রথম বাংলাদেশ সরকার (প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে রাজনৈতিক-সামরিক-কূটনৈতিক সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অবিচলভাবে নিয়োজিত তখন মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একটি সমান্তরাল সরকার কার্যরত ছিল।

কলকাতাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন মোশতাক আহমেদ, এ কারণে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। এই তথ্যটি কারও অজানা থাকার কথা নয়। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে ওই ৯ মাসের মাথায় সাফল্য লাভ করে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হবে- এ ধারণা পাকিস্তানপন্থি মানুষজনের মধ্যে ছিল না, ছিল না শাসক দল আওয়ামী লীগের ডানপন্থি প্রভাবশালী নেতাদেরও। যেমন খোন্দকার মোশতাক, তাহেরুদ্দীন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম, এমনকি ওবায়দুর রহমান, আব্দুল মালেক উকিল, কোরবান আলীর মতো নেতারা। এরা সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে ছিল। যখন তারা দেখল বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া ভুট্টোর প্রস্তাব ষড়ড়ংব পড়হভবফবৎধঃরড়হ প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান থেকে লন্ডন রওনা হচ্ছেন, তখন বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তটি উক্ত মহল মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশ যেন পাকিস্তানের সঙ্গে ক্ষীণ সম্পর্ক বজায় রাখে, শুধু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করাতে তারা খুবই ক্ষুব্ধ হন।’ মানস ঘোষ বাংলা স্টেটসম্যানের সাবেক সম্পাদক সাংবাদিকের চোখে বঙ্গবন্ধু- বাংলাদেশ, যিনি ‘৭২ সাল থেকে জুন ‘৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যুরো চিফ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

উক্ত মোশতাক-চাষী গংরা মুক্তিবিরোধী শক্তি, জামায়াত মুসলিম লীগ, নকশাল, সর্বহারাদের সঙ্গে হাত মেলায়- একের পর এক থানা আক্রমণ, অস্ত্রশস্ত্র লুট, ব্যাংক ডাকাতি, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। মোশতাকরা বঙ্গবন্ধুকে ঘায়েল করতে মওলানা ভাসানীর শরণাপন্ন হন। মওলানা ভাসানী বললেন- ‘মুজিব তুমি বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে বেইমানি করেছ। তাদের নামাজ-রোজা ও মুসলিম আদব-কায়দা কেড়ে নিতে চাইছ। বাঙালি মুসলমান তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। তুমি হিন্দুস্তানের ওই মহিলা প্রধানমন্ত্রীর কথায় দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ বানাতে চাইছ, তা কোনোদিন হবে না। আমরা বাংলাদেশকে মুসলিম বাংলা বানিয়েই ছাড়ব।’ তদুপরি ছিল মওলানা ভাসানী নামাঙ্কিত ‘হক কথা’ প্রচার করত সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ধ ভারতবিরোধী ধারাবাহিক অপপ্রচার।

দুই. বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত নিয়ে চার দশক ধরে গবেষণাকারী মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ ‘এন আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ গ্রন্থে বহু দলিলপত্র তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন, লেডিস ক্লাবের তুচ্ছ ঘটনার জের হিসেবে শেখ মুজিব খুন হননি, তিনি প্রমাণ করেছেন বহু আগেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ প্রতিনিধির সঙ্গে মুজিব হত্যাকারীরা যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। ব্রিটিশ সাংবাদিক ‘দি ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের ঘটনায় মার্কিন প্রশাসন তথা হেনরি কিসিঞ্জারের সম্মতি ছিল।গত ছেচল্লিশ বছরে মুজিব হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র নিয়ে অন্যতম গবেষণাকারী স্টানলি উলপার্ট তার গ্রন্থে মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর জড়িত থাকার দলিলপত্র হাজির করেছেন। ভুট্টো বাংলাদেশের কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে গোপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে সাহায্য অব্যাহত রাখেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করার জন্য ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের ‘র’-এর পরিচালক রামনাথ কাউ পান বিক্রেতার ছদ্মবেশে বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেন। ১৯৭৭ সালে ইউরোপের একটি শহরে খুনি লে. কর্নেল (অব.) খোন্দকার আব্দুর রশীদ অভ্যুত্থানের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব যোগাযোগ সম্পর্কে লিফ শুলজকে বলেন, জিয়াই আমাদের আশ্বস্ত করেছে- আমেরিকা আমাদের সঙ্গে আছে, অন্য কোনো তরফ থেকে বাধা আসবে না। লিফ শুলজ ইত্তেফাককে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বলেন ‘১৫ আগস্ট হত্যাকাে প্রধান ভূমিকা পালন করেন জিয়া- জিয়ার সহযোগিতা ছাড়া এই হত্যাকাণ্ড ঘটতই না।’

তিন. ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও পটপরিবর্তন নিয়ে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবির কী ভূমিকা ছিল, সে সম্পর্কে আমার গভীর কোনো ধারণা নেই। বঙ্গবন্ধুর সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার পালাবদলের আশঙ্কা তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ওই হত্যাকাে র পরে সোভিয়েতের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ কথাবার্তায় তাদের এহেন হত্যাকাণ্ড ও পটপরিবর্তনে দুঃখ প্রকাশ করতে শুনেছি।

এ প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চাই। তৎকালীন বুলগেরীয় রাষ্ট্রদূত (অসনধংংধফড়ৎ চষবহরঢ়ড়ঃবহঃরধৎু) ছিলেন বরিস বায়াজদিক, বয়স ৮৭, যিনি হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে দীর্ঘদিন পাশবিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও ভাগ্যগুণে বেঁচে যান। তিনি আমাকে ১১ জুলাই ১৯৭৫ সালে জরুরিভাবে সাক্ষাৎ করার জন্য খবর পাঠান। সেদিন সন্ধ্যায় তার বাসভবনে আমি সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে বলেন, অচিরেই একটা রক্তাক্ত সেনা অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে বলে তিনি জেনেছেন। নিম্নস্তর ও মধ্যস্তরের কিছু সেনাসদস্য এই অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তুতি নিয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হতে পারে। এ পর্যন্ত শোনার পরে আমি রাষ্ট্রদূতকে বলি- এই গুরুতর মারাত্মক সংবাদটি তিনি কেন রাষ্ট্রপতিকে নিজে বলছেন না। উত্তরে রাষ্ট্রদূত বলেন, ভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ হয় কিনা বিষয়টি বিবেচনা করে তিনি আমাকে দিয়ে ওই দুঃসংবাদটি রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করতে চিন্তা করেছেন- তিনি এও জানেন, বঙ্গবন্ধুর কাছের একজন বিশ্বস্ত মানুষ আমি।

যা হোক, পরদিন সম্ভবত ১২ জুলাই ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ফরহাস উদ্দীনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। বিনা ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদূতের সতর্কবার্তা জানাই। রাষ্ট্রদূত এ মর্মে সাবধান করেছেন যে, ৩২ নং বাসভবনের পরিবর্তে তাকে অবশ্যই নিরাপত্তার খাতিরে গণভবনে নিরাপত্তা বূ্যহ তৈরি করে থাকতে হবে, কেননা ৩২ নং দ্বিতল বাড়িটি শত্রুদের আঘাত করার সহজ লক্ষ্যস্থল হবে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিক্রিয়া পাই এই মর্মে যে, কারা ঘটাবে এ ঘটনা? আমার বুকে অস্ত্র তাক করতে তাদের হাত কাঁপবে না? আমি ভাত-কাপড় সবাইকে দিতে না পারি, জেল-জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে স্বাধীনতা এনে দিই নাই?। একপর্যায়ে তিনি বলেন, কারা নিম্নস্তর ও মধ্যস্তরের সেনা অফিসার যারা আমাকে হত্যা করবে? তিনজন বহিস্কৃত সেনা সদস্য আমার কাছে এসে সেনাবাহিনীতে পুনর্বহাল হতে কান্নাকাটি করেছে- ডালিম, রশীদ ও ফারুক। নিজের অজান্তে বঙ্গবন্ধু তার সম্ভাব্য খুনিদের নাম বলে দিলেন। কী নিরাপত্তা ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা তিনি নেবেন আমি জানতে চাই বঙ্গবন্ধুর কাছে। প্রথমত, তিনি বলেন, ‘তোর ভাবি ৩২নং-এর বাড়ি ছাড়তে কোনো রকমেই রাজি না- গণভবনে থাকতে রাজি না, তোদের ভাবি পিঁয়াজ-মরিচ-সবজির বাগানের মায়া ছেড়ে গণভবনে আসতে চায় না- সবচেয়ে বড় কথা জীবনের একটা বড় অংশ তুমি জেলে জেলে কাটিয়েছ- এখন আমার সঙ্গে তুমি থাকবে। কী প্রতিষেধক ব্যবস্থা নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেনচ্ রক্ষীবাহিনীর নুরজ্জামানকে পাঠিয়েছি যুগোস্লাভিয়ায় মার্শাল টিটোর কাছে এন্টিট্যাঙ্ক গান আনতে, সেনাবাহিনীকে মিসরের সাদত কয়েকটি ট্যাঙ্ক দিয়েছে, এক মাসের মধ্যে এন্টিট্যাঙ্ক আসবে। এই কথোপকথনের মধ্যে একজন সচিব হলুদ ফাইল নিয়ে ঢুকলেন, যিনি পাকিস্তান পুলিশের দ্বিতীয় ব্যক্তি- বাঙালি আব্দুর রহিম যিনি ১৯৬৭ সালে আমাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন স্বাধীন বাংলা নামে এক ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে। আমার অনুমান বঙ্গবন্ধুর জবানিতে এন্টিট্যাঙ্ক গানের কথা নিশ্চিত করে শুনতে তার আকস্মিক এই আগমন। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায়কালে তিনি বলেন, মনিদা, মোজাফফরকে সাবধানে থাকতে বলিস। ইন্দোনেশিয়ায় কী হচ্ছে দেখছিস না। আমাকে হটাতে চাইলে আমি জনতার কাতারে চাদরটা গায়ে বাউলি মেরে চলে যাব। তারা আমাকে রক্ষা করবে চিন্তা করিস না।’ ফিরে আসব বলে পা বাড়িয়েছি এমন সময় হন হন করে মোশতাক ঢুকছিল রাষ্ট্রপতির কক্ষে। বঙ্গবন্ধু বলেন, পঙ্কজ দেখে যা আমার রিঅ্যাকশনারি নেতাকে। কী রিঅ্যাকশনারি নেতা, কেমন আছেন? মোশতাক তাৎক্ষণিক জবাব দেয়চ্ নেতা আপনার জীবদ্দশায় আমি আপনার বিরোধিতা করব না। খুনি মোশতাক যখন নিশ্চিত হয় যে, বঙ্গবন্ধুর গুলিতে ঝাঁজরা হওয়া দেহটি সিঁড়ির ওপর নিথর নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে, তখন তিনি রেডিওতে ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেন। খুনি তার কথা রেখেছিল।

You might also like