ভক্তি ধর্ম রাজনীতি
দিলীপ মজুমদার
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকে বিজেপি ধর্মীয় বিভাজনের নীতি দিয়ে লাভের অঙ্ক কযছিল।সৌভাগ্যবশত রাজ্যের মানুষ এই বিভাজনের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।বলা যেতে পারে,এটা এই রাজ্যের ঐতিহ্য।কংগ্রেস,বাম,তৃণমূল কোন দলের রাজত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উগ্রতা এই রাজ্যে দেখা যায় নি।তার জন্য এখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভূমিকা বিরাট।বাংলার লেখক,কবি,শিল্পী,বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের সাহিত্যে,গানে,শিল্পে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রচার করেছেন,তাকে পরম মমতায় লালন করেছেন।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই মত ও পথ সারা দেশ গ্রহণ করে নি । বিশেষ করে গ্রহণ করে নি উত্তর ভারত।অনেকদিন আগে সংবিধানপ্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেডকর এই আশঙ্কার কথা বলে গিয়েছিলেন।বলেছিলেন সমাজ যদি ধর্মীয় বিভাজনকে লালিত করে,যদি সমাজটা অগণতান্ত্রিক হয়ে থাকে ,তাহলে রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যায় ।ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ।কিন্তু সে দেশের সমাজে স্বাধীনতা,সাম্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত নয় । বিজেপি ঠিক এই সুযোগটাই নিয়েছে।অটলবিহারীর প্রধানমন্ত্রীত্বের পাঁচ বছরে সলতে পাকানোর কাজ চলছিল, মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কালে ধর্মী্য় বিভাজনকে ব্যাপকভাবে রাজনীতির কাজে লাগানো হল ।
বাবাসাহেব আম্বেডকরের ভবিষ্যদ্বাণী যে কত সঠিক ছিল, তার প্রমাণ পাই সাম্প্রতিককালের একটি সমীক্ষায় । পিউ রিসার্চ সেন্টার নামে আমেরিকার একটি তথ্যবিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ২০১৯-২০তে ‘সহিষ্ণুতা ও পৃথকীকরণ’ নামে একটা সমীক্ষা করেছিল । তাতে দেখা যাচ্ছে দেশের এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে মানসিকভাবে ‘পৃথক’ বলে মনে করেন । হিন্দুর কাছে যেমন হিন্দুই আত্মার আত্মীয়, তেমনি মুসলমানের কাছে মুসলমানই আত্মার আত্মীয়।এরা পাশাপাশি বাস করছে বটে, কিন্তু মনের গভীরে একের প্রতি অপরের অনাত্মীয়সুলভ অনীহা।শুধু হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কে নয়, এ কথা ভারতে বসবাসকারী বৌদ্ধ, শিখ, খ্র্রিস্টানদের সম্পর্কেও সত্য।তাই ‘বিবিধের মাঝে আজি মিলন মহান’ কেবল বাঙালি কবির কথা হয়েই রইল।সমগ্র ভারতে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।আর ঠিক এটাই বিজেপির শক্তির উৎস।মহামতি গোখলে বলেছিলেন ‘আজ বাঙালি যা ভাবে কাল গোটা ভারত তা ভাববে’ ।না,বাঙালির ভাবনার শরিক সমগ্র ভারতবাসী হয় নি।একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞাতার কথা বলি।বছর কয়েক আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম খাজুরাহ ।এক লোকালয়ের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে তেষ্টা পাওয়ায় একটি বাড়িতে গিয়ে এক গ্লাস জল প্রার্থনা করি।সে বাড়ির কর্তা জানতে চান আমি ব্রাহ্মণ কি না।ব্রাহ্মণ না হলে জল মিলবে না।পিউ রিসার্চ সেন্টারের এই সমীক্ষা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বাঙালির উদার,পরমতসহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক আদর্শ ভারতবর্ষ গ্রহণ করে নি।
লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।