রঙ্গভরা বঙ্গদেশ
দিলীপ মজুমদার
এ সময়ে হুতোম প্যাঁচা থাকিলে বড় ভালো হইত।তিনি মজা করিয়া কলিকাতা তথা বঙ্গদেশের রঙ্গগুলির কথা বলিতে পারিতেন।নিত্য নতুন রঙ্গ দেখিতে দেখিতে হুতোমের কথা বড় মনে পড়ে । আপশোশ হয় ।সামাজিক রঙ্গ অপেক্ষা রাজনৈতিক রঙ্গ এখন প্রধান স্থান দখল করিয়াছে ।রাজনৈতিক নেতাদিগকে অভিনয়বিদ্যায় কে দীক্ষা দিয়াছিল, জানি না ;তাঁহারা ক্ষণে ক্ষণে হাসিয়া- কাঁদিয়া , নানাবিধ ছলাকলার দ্বারা বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জমাইয়া তুলিয়াছেন ।উত্তমকুমার, দিলীপকুমার, সুচিত্রা সেন , অমিতাভ বচ্চন প্রভৃতিরা রাজনৈতিক কুশীলবের সহিত পাল্লা দিতে ব্যর্থ হইয়াছেন ।বঙ্গদেশে বিধানসভার নির্বাচনের পূর্ব হইতে শুরু হইয়াছে রঙ্গ ।তখন করোনাসুর প্রবলভাবে অবস্থান করিতেছিলেন । নানা রঙ্গ দেখাইতে ছিলেন তিনি।পরীক্ষা লইয়া, চিকিৎসা পরিষেবা লইয়া , মৃত্যু লইয়া বিরোধীরা গগনবিদারী চিৎকার শুরু করিয়াছিলেন । শাসকদল আত্মপক্ষ সমর্থনে অবিচল থাকিয়া কেন্দ্রকে দোষ দিতেছিলেন ।কিন্তু এ দেশের শাসকরা বড় গণতন্ত্রপ্রিয় । অতএব করোনার প্রবল আবহেও নির্বাচনের ঘন্টা বাজাইয়া দিলেন তাঁহারা । কেন্দ্রের শাসকদলের পাখির চোখ ছিল বঙ্গদেশ । তাঁহারা বঙ্গে মাসাধিক কালের ভোটের নির্ঘন্ট নির্মাণ করিলেন । আটটি ফেজে ভোট হইবে । প্রতিবাদ করিলেন বঙ্গের শাসকরা ।
গণতন্ত্রপ্রিয় রাজনীতিকরা করোনাসুরকে বুড়া আঙুল দেখাইয়া সভা-সমিতি-মিছিল- মিটিংএর আয়োজন শুরু করিলেন । দিল্লিসহ নানা প্রদেশ হইতে নেতা-ফিতারা ডেলি প্যাসেঞ্জারের মতো আসিতে লাগিলেন বঙ্গে । এখানকার হোটেল, রিসর্টগুলি তাঁহাদের কৃপায় কিছু পুষ্ট হইল । বঙ্গের শাসকদল সেই সব নেতাদের ‘বহিরাগত’ বলিয়া দাগাইয়া দিতে তর্ক উঠিল । টিভি চ্যানেলগুলিতে বসিয়া পড়িলেন স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞরা । যুক্তি-তর্ক অচিরে চিৎকারে পর্যবসিত হইল । গলার জোরে, খেউড়ের তরঙ্গে রমরম করিতে লাগিল চারিদিক ।ভবানীপুর ছাড়িয়া শাসকদলের নেত্রী দাঁড়াইয়াছিলেন নন্দীগ্রামে । প্রতিপক্ষ ছিলেন দলত্যাগী শুভেন্দু অধিকারীবাবু । নেত্রী নন্দীগ্রামে প্রচারে গিয়া পায়ে আঘাত পাইলেন । বিরোধীরা বলিলেন নাটক । পূর্ব পূর্ব নাটুকেপনার নজির তুলিয়া ধরিলেন তাঁহারা । দিন কতক হাসপাতালে থাকিয়া নেত্রী হুইলচেয়ারে বসিয়া ঘুরিতে লাগিলেন দেশময় । একটা ফুটবল লইয়া তাহাতে একটা লাথি ঝাড়িলেন । তখন চারিদিক প্রকম্পিত করিয়া স্লোগান উঠিল ‘খেলা হবে খেলা হবে’ । কালক্রমে এই ‘খেলা হবে’ তাঁহাদের রণসংগীতে পরিণত হইল । প্রধানমন্ত্রীও ব্যঙ্গ করিয়া বলিলেন ‘খেলা হোবে’ । বঙ্গ বিজেপির সভাপতি মহাশয় অকপট মানুষ । তাঁহার মুখের কোন লাগাম নাই । তিনি শাসকদলের নেত্রীকে বারমুডা পরিবার বিধান দিলেন । তাহা লইয়াও তর্ক উঠিল । সংস্কৃতির পীঠস্থান বঙ্গদেশে এ কি অসংস্কৃত ভাষা !
ফল ঘোষণার দিন নাটকের পর নাটক । অমিত শা্হজি দৃঢ় প্রত্যয়ে জানাইয়া গিয়াছিলেন যে তাঁহারা জিতিতেছেন । ২০০-এর উপরে তাঁহারা আসন লাভ করিবেন । তাঁহার দলের লোকেরা বিজয় মিছিলের প্রস্তুতি করিয়া রাখিয়াছিলেন । কিন্তু বেলা বাড়িতেই তাঁহাদের মুখ চুপসাইয়া গেল । শেষ পর্যন্ত সাতের ঘরে আটকাইয়া রহিলেন তাঁহারা । ‘বিজেমূল’এর বিরোধী বাম ও কংগ্রেস খাতা খুলিতে পারিল না, বহু কেন্দ্রে তাহাদের জামানাপ্ত অর্থাৎ জামানত বাজেয়াপ্ত হইল । ইহার মধ্যেও রঙ্গ আছে । যে আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সহিত জোট করিয়াছিল বাম ও কংগ্রেস, যাহা লইয়া সেই দুই দলের অভ্যন্তরে কথা উঠিয়াছিল, সেই আব্বাসবাবুদের দল পাইল একটি আসন ।তৃণমূল ২০০ পার করিল । কিন্তু নন্দীগ্রামে রঙ্গ হইল । টিভিতে দেখা গেল মমতা ব্যনার্জী শুভেন্দুবাবুকে ১২০০ ভোটে হারাইয়া দিয়াছেন। সংবাদ দিয়াছেন এ এন আই । তাহার পর অখন্ড নীরবতা । তাহার কয়েক ঘন্টা পরে ঘোষিত হইল শুভেন্দুবাবু জিতিয়া গিয়াছেন । শাসক দল বলিলেন গন্ধটা বড় সন্দেহজনক । আদালতে যাইবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিলেন তাঁহারা । জায়েন্ট কিলার হিসাবে অধিকারীবাবুর মান ও প্রতিপত্তি বাড়িল । তাঁহার হাঁটাচলার ভঙ্গি বদলাইয়া গেল । তাঁহার দলের দিল্লির নেতৃত্ব তাঁহাকে কদর করিতে লাগিলেন । বঙ্গ বিজেপির দোর্দন্ডপ্রতাপ সভাপতির ভাবমূর্তি ম্লান হইতে লাগিল ।
হিড়িক পড়িল দলবদলের । নির্বাচনের পূর্বে বিজেপি জিতিতেছে বলিয়া তৃণমূলের অনেকে বিজেপিতে চলিয়া গিয়াছিলেন । তৃণমূল তাঁহাদের ‘গদ্দার’ বলিয়া দাগিয়া দিয়াছিলেন । সেই গদ্দাররা এবার ঘরে ফিরিতে চাহেন । সোনালি কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিলেন । রাজীব শুভেন্দুর বিরুদ্ধে গরম গরম বাক্যবাণ ছাড়িতে লাগিলেন । দলবদলের রঙ্গ জমিয়া গেল ।
আশা ও স্বপ্ন পূর্ণ হয় নাই । নির্বাচনে পরাজয় হইয়াছে । তথাপি বিজেপি মচকাইতে চাহে না । কোন রাজনৈতিক দলই তাহা চাহে না । ছুতা খুঁজিতে থাকে । বিজেপও ছুতা খুঁজিয়া পাইল । সেই ছুতা হইল আইন-শৃঙ্খলার অবনতি । এমন বলিতেছি না যে তৃণমূল বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা লইয়াছে । সহিষ্ণুতায় পারঙ্গম হইয়াছে । রাজনীতির সহিত ক্ষমতাদখলের হিংসা যুক্ত থাকে । কিল-চড়-ঘুষিতে সে হিংসা সীমাবদ্ধ থাকে না । আরো শাণিত অস্ত্রের দীপ্তি উদ্ভাসিত হয় । তবে বিজেপির চিৎকারে অতিরঞ্জন ছিল । স্বাভাবিক । বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তৃণমূল পরাজিত হইয়া এরূপ চিৎকার করিয়াছিল । বিজেপি অভিযোগ করিতে লাগিল তাহাদের কর্মী-সমর্থকদের শাসকদলের লোকজন পিটাইতেছে , ঘর ছাড়িতে বাধ্য করিতেছে ।পরাজিত বিজেপির এই চিৎকার গতি পাইল রাজ্যপাল মহাশয়ের কার্যক্রমে । বঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে বর্তমান রাজ্যপালের সত্যই কোন তুলনা নাই । রাজভবনে ঢুকিয়াই ইনি শাসকদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন । সেরূপ করিবার জন্য ইঁহাকে প্রেরণ করা হইয়াছিল কি না তাহা সবিশেষ জানা যায় নাই । ইনি শয্যাত্যাগ করিয়া টুইট করেন , দ্বিপ্রহরে ভাতঘুমের পরে টুইট করেন, নিশা সমাগমে টুইট করেন , এমন কি মধ্যরাতে জাগিয়া উঠিয়া টুইট করেন । সে সব টুইটে থাকে শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ । কখনও আইন-শৃঙ্কলা, কখনও শিক্ষা, কখনও স্বাস্থ্য লইয়া । শাসক ও বিরোধীর তরজার রঙ্গে রাজ্যপাল মহাশ্য় নতুন রঙ্গ যুক্ত করিয়া দেন । এবার তিনি বলিতে লাগিলেন রাজ্যের শাসক দল হিংসা ত্যাগ না করিলে তাঁহাদের ভয়াবহ পরিণামের শাস্তি পাইতে হইবে । রাজভবনের আরাম ত্যাগ করিয়া রাজ্যপাল সরজমিন তদন্ত করিবার জন্য কপিলাবাস্তুর রাজকুমারের মতো পথে বাহির হইলেন । সঙ্গে লইলেন বিজেপি সাংসদকে । ইহাতে শাসকদলও ধুম মাচাইয়া দিলেন । বলিতে লাগিলেন রাজ্যপাল নিরপেক্ষ নহেন , তিনি প্রকারান্তরে বিজেপির মুখপাত্র । তাঁহারা নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্যপালের ভূমিকা লইয়া গগনবিদারী চিৎকার শুরু করিয়া দিলেন । শীতলখুচি লইয়া খোঁচাইতে লাগিলেন ।
দিন তিন চার পরে আবার জমাট নাটক ।
রাজ্যপাল মহাশয়ের সম্মতিক্রমে সিবিআই মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জী ও ফিরহাদ হাকিম, বিধায়ক মদন মিত্র , কলিকাতার প্রাক্তন মেয়র ও মন্ত্রী শোভন চ্যাটার্জী মহাশয়দের গ্রেপ্তার করিল ঊষাকালে । গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে । কর্মী-সমর্থকরা করোনাকে তুড়ি মারিয়া ছুটিয়া গেলেন সিবিআই চত্বরে । নেতাদের অপমান বলিয়া কথা ! প্রতিবাদ গাঁধীপ্রদর্শিত পথ অতিক্রম করিয়া গেল অচিরে । ইট-পাটকেল নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল । মুখ্যমন্ত্রীও ছুটিয়া গেলেন । কয়েকঘন্টা বসিয়া রহিলেন । গেলেন আইনমন্ত্রীও । তাঁহাদের উপস্থিতি লইয়া প্রশ্ন তুলিল সিবিআই । নিম্ন আদালতে জামিন হইলেও সেই রাত্রিকালে সিবিআই দ্বারস্থ হইলেন হাইকোর্টের । জামিন নামঞ্জুর হইল । এদিকে রাজভবনের সম্মুখে এক ছোকরা একপাল ভেড়া লইয়া দাঁড়াইয়া গেল । সে বোধহয় বলিতে চাহিল, ;’রাজ্যপাল ভেড়ার পাল ‘ ।
অভিযুক্তদের তিনজন অসুস্থ বোধ করায় তাঁহাদের পি জি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হইল । বিরোধীরা বলিলেন ইহা নাটকের রঙ্গ । এদিকে যে বান্ধবীর জন্য শোভন চ্যাটার্জীবাবু স্ত্রী-পুত্র-দল ছাড়িয়াছিলেন, তাঁহার কক্ষেও অভিনীত হইতে লাগিল নাটক । তাঁহার বান্ধবী কাঁদিয়া-কাটিয়া নাটক জমাইয়া দিলেন । নিন্দুকেরা বলিতে লাগিল : লাগ ভেলকি লাগ । ইহার মধ্যে কালারফুল মদন মিত্র রঙিন জামা পরিয়া, গান গাহিয়া, ‘লাভলি লাভলি’ বলিয়া হাসপাতাল মাতাইয়া দিলেন ।
দেখিতে দেখিতে আসিয়া পড়িল ইয়াস ।
মত্যভূমিতে মানুষের মতো প্রকৃতিও রঙ্গে মাতে । ইয়াস ঝড়ও রঙ্গে মাতিল । মেদিনীপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বহু অঞ্চল জলমগ্ন হইল, ঘরবাড়ি পড়িয়া গেল , শস্য ও গবাদি পশু বিনষ্ট হইল । এবার শুরু হইল ত্রাণ লইয়া নতুন নাটক । বিরোধীরা ত্রাণের গাফিলতি, স্বজন-পোষণ লইয়া সরকারকে দোষারোপ করিতে লাগিল , শাসকদল নিজেদের ধোয়া তুলসীপাতা সাব্যস্ত করিতে সর্ববিধ চেষ্টা করিতে কসুর করিলেন না । কেন বাঁধ হয় নাই, কেন ম্যানগ্রোভ নষ্ট হইল তাহা লইয়া চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনার হাট বসিয়া গেল । শাসকদল রাজীব, শুভেন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপাইতে তাঁহারাও রে রে করিয়া বাক যুদ্ধে লাফাইয়া পড়িলেন । রসিক মানুষ বলিতে লাগিলেন : এ তো বড় রঙ্গ যাদু, এ তো বড় রঙ্গ ।
কথায় বলে জো জিতা ওহি সিকিন্দর । ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয় হইয়াছে । আপাতত বিজেপিতে কিছু প্রাপ্তির আশা নাই । পরাজয়ের পর সে দলের ভিতর কোন্দল শুরু হইয়াছে । আদি-নবর দ্বন্দ্ব । আদি বিজেপির লোকেরা বলিতেছেন তৃণমূলের গদ্দারদের অবাধ অনুপ্রবেশে দলের এই হাল হইয়াছে । এদিকে যাঁহারা বিজেপিতে গিয়াছিলেন, তাঁহারা তৃণমূলে ফিরিতে ইচ্ছুক । তাঁহাদের মস্তক মুণ্ডন করিয়া, কান ধরিয়া উঠ-বস করাইয়া , স্যানিটাইজার ছিটাইয়া শুদ্ধ করিয়া তৃণমূলে ঢোকানো হইল । শুদ্ধিকরণের সে দৃশ্য দেখিলে অশ্রুসংবরণ করা কঠিন । বিজেপির মতো বামেরাও পরাজয়ের কারণ খুঁজিতে বসিয়া গেলেন । এক বিদ্রোহী সদস্য বলিলেন, পরাজয়ের এই দায় নেতৃত্বকে লইতে হইবে । তাঁহাকে শোকজ করা হইল । হইবেই তো । এ দেশে কোন নেতা কখনও কোন দায় লন নাই, তাহা কর্মীদের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়াছেন । লাভের গুড় তাঁহারা গলাধঃকরণ করেন, বোকা মহাদেবের মতো কর্মীদের নীলকণ্ঠ হইতে হয় । বিজেপির যে সব প্রবাসী নেতা ভোট পরিচালনা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের গায়েও আঁচড়টি লাগিল না । তথাপি কর্মীরা বলিতে লাগিলেন , নেতা ধর্ম , নেতা স্বর্গ ।
রাজ্যের মুখ্যসচিবকে লইয়া বেশ এক দফা রঙ্গ হইয়া গেল । কলাইকুণ্ডায় তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কথায় চলিয়াছিলেন , প্রধানমন্ত্রীকে জো-হুজুর করেন নাই । তাই তাঁহার দিকে দিল্লির রক্তচক্ষু ধাবিত হইল । রাজ্য সরকার তাঁহাকে তিন মাস এক্সটেনশন দিয়াছিলেন , কিন্তু দিল্লি তাঁহাকে তলব করিলেন । তখন মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাকে অবসর দিয়া কিস্তি মাত করিতে চাহিলেন । কিন্তু কেন্দ্র ছাড়িবার পাত্র নহে । কি করিয়া মুখ্যসচিবকে ফাঁসানো যায় তাহার ফিকির খুঁজিবার চেষ্টা চলিতেছে ।
শাসক দলের এক নারী সাংসদ ছিলেন সুন্দরী অভিনেত্রী । তিনি মুসলমান হইয়াও বিবাহ করিয়াছিলেন এক হিন্দু পুরুষকে । শাঁখা-সিঁদুর পরিয়া মন্দিরে গিয়াছিলেন । টানিয়াছিলেন ইসকনের রথ । পরে তিনি বলিতে লাগিলেন এ বিবাহ বিবাহই নয় । অতঃপর তাঁহাকে এক অভিনেতার সহিত ঘনিষ্ঠ হইতে দেখা গেল । স্বামীর সহিত সম্পর্কছিন্ন হইয়াও তিনি কেমন করিয়া গর্ভবতী হইলেন , সে প্রশ্ন উঠিল । কিন্তু নারীবাদী সাংসদ তাহাকে গ্রাহ্য করিলেন না । বিরোধী দলের লোকেরা তাঁহাকে ধিক্কার দিয়া রক্ষণশীল মনের পরিচয় স্থাপন করিলেন । তসলিমা নাসরিনের মতো নারীবাদীরা তাঁহার পক্ষ লইলেন । ইহাই তো প্রেমের লীলা । যুগ যুগ ধরিয়া এই লীলা চলিতেছে । এক্ষণে এই লীলায় অবগাহন করিয়াছেন শোভন- বৈশাখী । শোভন ছিলেন হেভিওয়েট মন্ত্রী ও মেয়র । বৈশাখী ছিলেন অধ্যাপিকা । দুজনেই ছিলেন বিবাহিতা , দুজনেরই সন্তান ছিল । প্রেমের এমনই লীলা যে দুজনেই সে সব পরিত্যাগ করিলেন এক লহমায় । দুজনে এখন নাচিতেছেন, গাহিতেছেন, ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়া হাওয়া খাইতেছেন । তাঁহাদের কাছে ‘সমাজ সংসার মিছে সব / মিছে এ জীবনের কলরব ।‘’
আদালত চত্বরে আবার জমিল রঙ্গ । নন্দীগ্রামের পরাজয় মানিতে পারেন নাই শাসক দল । তাঁহারা দ্বারস্থ হইলেন আদালতের । বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে বিচার । কিন্তু শাসকদল বলিলেন এই বিচারপতি বিজেপির লিগাল সেলে ছিলেন, মামলা লড়িয়াছেন বিজেপির হইয়া, অতএব ইনি নিরপেক্ষ বিচার করিতে পারিবেন না । আইনজীবীরা এই ব্যপারে দ্বিধাবিভক্ত হইলেন ।
নিউটাউনের ‘সুখবৃষ্টি’ আবাসনে ঘাপটি মারিয়াছিল পঞ্জাবের দুই সন্ত্রাসবাদী । পুলিশ সেখানে অপারেশন চালাইল । পুলিশের গুলিতে দুই সন্ত্রাসবাদী নিহত হইল । অনেকেই পুলিশের প্রশংসা করিলেন । কিন্তু বিরোধীরা বলিতে লাগিলেন এ রাজ্য সন্ত্রাসবাদীদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়, ইহাতে শাসকের প্রশ্রয় আছে । শুনিয়া রে রে করিয়া উঠিলেন শাসক দলের সদস্যরা । দল ও নেতারা কদাচ নিজেদের খামতি স্বীকার করেন না । নৌটাঙ্কি করিয়া তাঁহারা বুঝাইয়া দেন যে তাঁহারা নিষ্কলঙ্ক । দলীয় কর্মীরা সুর করিয়া বলিতে থাকেন : দোষ কারো নয় গো মা / দোষ কারো নয় ।
মুকুল রায় মহাশয় তৃণমূল হইতে বিজেপিতে গিয়াছিলেন । আবার তিনি তৃণমূলে ফিরিয়া আসিয়াছেন । না, তাঁহাকে সবিশেষ শুদ্ধ হইতে হয় নাই । কেন হয় নাই, তাহার কারণ জান সাধু যে বুঝ সন্ধান । বিজেপিতে যাইবার কালে তিনি যেমন দল ভাঙানোর খেলা খেলিয়াছিলেন, তৃণমূলে ফিরিয়া তদ্রূপ খেলা শুরু করিলেন । মধ্যে স্ত্রীবিয়োগ হওয়াতে একটু দমিয়া গিয়াছিলেন, এই যা । মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাকে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ার পার্সন করিতে চাহিলেন । বিজেপি তাহার বিরোধিতা করিল । মুকুলবাবু এখনও বিধায়ক পদ ত্যাগ করেন নাই, ত্যাগ করেন নাই বিজেপির সদস্য পদ । সেই সুযোগ লইয়া শাসক দলের নেত্রী বলিলেন তিনি পি এ সির সভাপতির পদ তো বিজেপিকেই দিয়াছেন । শঠে শাঠ্যং । কিন্তু শুভেন্দুবাবু মুকুলবাবুকে দেখিয়া লইবেন বলিয়া তড়পাইতেছেন । ইদানীং শুভেন্দুবাবুর তড়পানিটা মাত্রাধিক্ হইতেছে । তাঁহাকে কে স্মরণ করাইয়া দিবে ব্রিটিশ আইনজীবী আইভর জেনিংসের কথা , যিনি ভারতীয় সংবিধানকে ‘আইনজীবীদের স্বর্গ’ বলিয়াছিলেন ।
এবার রঙ্গমঞ্চে আসিয়া পড়িলেন দেবাঞ্জন দেব মহাশয় । ইনি রাজনীতির লোক নহেন । কিন্তু রাজনীতিকদের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে । এ যুগে রাজনৈতিক নেতাটেতাদের সহিত যোগ না থাকিলে জীবন-জীবিকার সমস্যার সমাধান হয় না । কাটমানি হয় না , চিটফান্ড হয় না । সাংসদ মিমি চক্রবর্তী মহাশয়ার অভিযোগে প্রমাণিত হইল দেব মহাশব কসবা অঞ্চলে একটি ভুয়া ক্যাম্প খুলিয়া করোনার ভুয়া টিকা সরবরাহ করিতেছিলেন । পৌরসভা ও সরকারি কর্মচারী সহিত তাঁহার যোগ ছিল । তা না হইলে এত বড় নেট ওয়ার্ক চালানো সম্ভব হইত না । বিরোধীরা সরব হইলেন । তাঁহারা সিবিআই তদন্ত চাহিলেন । বিরোধী নেতা শুভেন্দুবাবু মহাশয় গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইলেন । আত্মপক্ষ সমর্থনে সরকার বাহাদুরও নানা পরিসংখ্যান হাজির করিলেন । একটা বাড়ি ভাঙিলে যেমন পর পর বাড়ি ভাঙার ঘটনা প্রকাশ পায় , তদ্রূপ দেবাঞ্জনের পরে অনেক ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া আইনজীবীর সন্ধান পাওয়া যাইতে লাগিল ।
বাবুল সুপ্রিয় মহাশয় বিজেপির সাংসদ ও মন্ত্রী ছিলেন । বিধানসভা নির্বাচনে তাঁহাকে টালিগঞ্জ বিধানসভায় নামানো হইয়াছিল । তিনি পরাজিত হইলেন । তাহার পরে তাঁহার মন্ত্রীত্ব চলিয়া গেল । বাবুল মহাশয় ক্ষুব্ধ হইলেন । তিনি সংসাদ পদ ও বিজেপি ছাড়িবার সিদ্ধান্ত লইলেন । এমন কি রাজনীতি ছাড়িবার কথাও বলিলেন । তাহার পর কি হইল কে জানে, বাবুল মহাশয় যোগ দিলেন তৃণমূলে । নিন্দুক বলিল, অভিনেতা-অভিনেত্রী, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের বিজেপি ধরিয়া রাখিতে অক্ষম । তাহাদের না কি সে ক্যালিবার নাই । তাই সময়ের আগে দিলীপ ঘোষ মহাশয়কে অপসারিত করিয়া উত্তরবঙ্গের এক অধ্যাপককে রাজ্য সভাপতির পদে বসানো হইল । হয়তো ইনি সংস্কৃতিসম্পন্ন বাঙালির হৃদয় জয় করিতে পারিবেন । কিন্তু প্রথম রাউন্ডে অধ্যাপক মহাশয় একটু ব্যাকফুটে চলিয়া গেলেন গোদুগ্ধে সোনা থাকার সমর্থন করিয়া ।ছয়মাসের মধ্যে মমতাকে বিধানসভায় নির্বাচিত হইতে হইবে । তা না হইলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকিতে পারিবেন না । তাই উপনির্বাচনকে পিছাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছিল বিজেপি ।অবশেষে নির্বাচন কমিশন সম্মতি দিল । সামসেরগঞ্জ. জঙ্গীপুর ও ভবানীপুরে ভালোভাবেই জিতিল শাসকদল ।ভবানীপুরে বিশেষ দৃষ্টি ছিল । কিন্তু সেখানেও পুর্ববর্তী রেকর্ড ভাঙিলেন মমতা, আটটি ওয়ার্ডেই লিড দিলেন । শোচনীয় অবস্থা বামেদের । তাঁহারা জামানত জব্দের রেকর্ড গড়িয়া চলিলেন ।আজ এখানেই ইতি । বারান্তরে পরবর্তী রঙ্গগুলির কথা বলা যাইবে ।
লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।