শেখ হাসিনা- উল্টো পথের সারথি
ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
দৈনিক কালের কণ্ঠে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান স্যারের একটা লেখা সম্প্রতি ছাপা হয়েছে।শিরোনামটা ‘কক্ষপথে ফিরলো বাংলাদেশ’।এ মাসের ১৪ তারিখেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থ বছরে ৬.৮-এ দাঁড়াবে যা প্রত্যাশিত ৮.১৫-এর চেয়ে কম।তারপরও অধ্যাপক মান্নান স্যার মনে করছেন বাংলাদেশ আবারো কক্ষপথে। কারণটা সরল,একই সময় ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ১.৯ শতাংশ আর চীনের ১.২।সেটাও ভাল, কারণ এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আর ইটালির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে যথাক্রমে মাইনাস ৫.৯ এবং মাইনাস ৯.১ শতাংশ।
আজ যখন ’৭৪-এ দাঁড়িয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তখন নির্দ্ধিধায় বলা যায় ‘করোনা বছরে’ এই অর্জনটুকুর জন্যই ইতিহাস তাকে একদিন অন্য উচ্চতায় মূল্যায়ন করবে। একজন শেখ হাসিনা ইতিহাসে মূল্যায়িত হবেন নানা কারণে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর প্রতিদিনের বিশেষ আয়োজনে স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলাম সুভাষ সিংহ দা’র আমন্ত্রণে। সংযুক্ত ছিলেন মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন। জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় ঠেকানোয় ‘চ্যাম্পিয়ন অব দা আর্থ’ হিসাবে বিশ্ববাসী যুগে-যুগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মূল্যায়ন করবে, জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসাবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ৪৬তম বর্ষপূর্তির আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে এমনটাই বলছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার মত বহুমাত্রিক একজন মানুষ ইতিহাসে এরই মাঝে যে অমরত্বের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছেন এইটুকু বোঝার যোগ্যতা আমার আছে, তবে কেন আর কোন-কোন কারণে তা মূল্যায়নের দুঃসাহস আমি কখনোই করিনা। তারপরও আমার কাছে মনে হয় যে অসংখ্য, অজস্র কারণে মানব ইতিহাসে একজন শেখ হাসিনার নাম জ্বল-জ্বল করবে তার অন্যতম একটি কারণ তিনি ‘উল্টো পথের সারথি’।
আমরা কথায়, বক্তৃতায় প্রায়ই বলি এদেশে সম্প্রীতির ইতিহাসটা হাজার বছরের। আমাদের প্রিয় উদ্ধৃতি শ্রী চৈতন্যের সেই অমর উক্তি, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। শুধু আমরা কেন যেন ভুলে যাই অন্য সত্যটি যে, গত একশ’টি বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভূখণ্ডে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে এবং তাও করা হয়েছে নজিরবীহিনভাবে। ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ, পাকিস্তান আমলে নজরুল সাহিত্যের ইসলামীকরণ আর নিষিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশে জেনারেলদের বাংলাদেশ জিন্দাবাদ আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম- এ সবকিছুই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সাথে সাংঘর্ষিক।
এই ধারার বিপরীতে চলার সাহস প্রথম দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের পথ ধরে আওয়ামী লীগকে এদেশের গণমানুষের সংগঠনে পরিণত করা আর বাঙালির মননে আবারো অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাটি জাগ্রত করার শতভাগ কৃতিত্বটি তার। কাজটি অবশ্য খুবই কঠিন ছিল। এর সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রমাণ ’৭০-এর নির্বাচন, যেখানে ১৬৯-এর মধ্যে ১৬৭ আসনে জিতে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়। অথচ এই বিজয়ের অন্যপিঠের বাস্তবতাটা ছিল এই যে, পাকিস্তানের ২৫ বছরের বিরামহীন শোষণ-নিপীড়ন আর ’৭০-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী শাসকদের চরম উদাসীনতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও এই নির্বাচনটিতে প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোটার নৌকা মার্কার উল্টো প্রতীকে ভোট দিতে কার্পণ্য করেনি। অর্থাৎ সেদিনও প্রায় ২ কোটি বাঙালি মনেপ্রাণে পাকিস্তানই চেয়েছে, বাংলাদেশ চায়নি।
সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবে এই ২ কোটি আজ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটির আশেপাশে । উর্দুতে অসাম্প্রদায়িকতার কোন প্রতিশব্দ নেই। অসাম্প্রদায়িকতার উর্দু ‘লা-দ্বিনীয়াত’, যার বাংলা মানে দাঁড়ায় ধর্মহীনতা। এই ৫ কোটির মননে গেথে গেছে ‘লা-দ্বিনীয়াত’ আর পাকিস্তান। এই মানুষগুলো আসলে ‘প্রবাসী পাকিস্তানী’। এবং মজার ব্যাপার অনেক সময় এরা নিজেরাই তা জানে না। পাকিস্তান এদের মজ্জ্বাগত। এরাই কখনো বিএনপি তো কখনো জামায়াত। এদের কাছে গণতন্ত্র কখনো ‘ডক্টর সাহেবের ডক্ট্র্রিন’ তো কখনো ‘ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের মাইনাস ওয়ান’। এই বিরুদ্ধ স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালির অর্থনৈতিক আর প্রযুক্তিগত মুক্তির পাশাপাশি মনোজাগতিক মুক্তি নিশ্চিত করায় শেখ হাসিনার যে পথচলা তাও কখনোই সুগম ছিল না। এর প্রমাণ শুধু তার জীবন নাশের চেষ্টাই যে ক’বার করা হয়েছে তা দু’হাতের সব আঙ্গুলে গুণেও শেষ করা অসম্ভব।২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশ কিংবা ২১২০-এর সম্মৃদ্ধ বঙ্গীয় ব-দ্বীপটি যে একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির বাসভূমি হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে চিহ্নিত হবে, জাতির পিতার সেই স্বপ্নের সফল রূপকার ‘উল্টো পথের সারথী’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাস এজন্য তাকে মূল্যায়নে ভুল করতে পারে না। বাঙালির এই আশার বাতিঘর আজ পা রাখলেন ’৭৪-এ। এই বিশেষ দিনটিতে তার শতায়ুর জন্য আমার প্রার্থনা নিরন্তর।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।