সিলেট সিটিতে বন্যা: কারণ ও করনীয়
রুহুল কুদ্দুস বাবুল
আমরা নদীমাতৃক দেশের মানুষ। নদী আমাদের জীবনের সাথে মিশে আছে। নদী একসময় এ জনপদকে করেছে সমৃদ্ধ। মানুষের চলাচল ব্যাবসাবানিজ্য সবই ছিল নদী কেন্দ্রীক। নদী ছিল জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। নদীর সাথে সখ্যতায় ভাবুক মানুষ গান কবিতা রচনা করেছে। এ জাতির উন্নতির ব্যাপারে বস্তুগত ও ভাবগত প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে নদীর প্রভাব।
নদ-নদী যখন পাহাড় থেকে নেমে আসে তখন তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রচুর নুড়ি, পাথর আর পাহাড় ধসের মাটি। সমতলে নেমে এসে পলি, পাথর, নুড়ি ঝেড়ে ফেলে চলতে থাকে। আমাদের সিলেট অঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর উৎস পার্বত্য এলাকা।
বৃহত্তর সিলেট জেলা বর্তমান সিলেট বিভাগের প্রধান দুটো নদী সুরমা ও কুশিয়ারা। সহ এই বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে
ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য সিলেটের দুইদিক ঘিরে আছে, ভারতের এ অঞ্চলটি সিলেটের ভুপৃষ্ট থেকে অনেক উপরে। উপর থেকে প্রবাহিত নদ নদী ছাড়াও আরও অনেকগুলো নদী সুরমা কুশিয়ারার শাখা নদী। এমন ১১৪টি নদীর আছে। এর মধ্যে কয়েকটি নদীর নাম হচ্ছে–
পিয়াইন, ধলাই, লোভা, রাংপানি, খোয়াই, করাঙ্গি, চলতি, লাঘাটা, সারী, ক্ষ্যাপা, কালনী, রত্না, সুতাং, মহাসিং, রক্তি, মনু, অন্ধমনু , লোলা, কুড়া, বিলাস, পিংলি, দেওছই, ধনু, বড়দাল, কংস, ডাউকা, চামটি, সুনাই, কন্টিনালা, মাকুন্দা, দৌলতা, খাজাঞ্চি, ফানাই, ধোনা, বলভদ্র, খাসিয়ামারা, গন্ডামারা, ইছামতি, ডেবনা, বিজনা, কচুয়াখাড়া, মুনিয়া, সাতাই, ধামালিয়া, জামালপুর, কালিয়া, পাটলী, বোয়ালিয়া, মাধবপুর, বিবিয়ানা, ধরিয়ানা, দিঘড়- পিয়াইন, বাসিয়া, কলকলিয়া, কচুয়া, গোয়াইন, শস্যনালী, জুঘনাল, দাড়াইন, কানাই, জুড়ী, নলজুর, পাইকরতলা, ধোয়াই, নুনছড়া, গুগালীছড়া, কাফনা, কাকেশ্বর, উন্দাখালি, ঠেংগাখালী, উদনা, ভাদেশ্বর, কামারখালি, কানাইখালী, পৈন্দা, মনিখাই, নয়াগাঙ, বড়গাঙ, ছড়াগাঙ, কাউনাই, সুমেশ্বরী, ঝিংড়ী, কুইগাং, মনাই, সোনাই, বড়ভাগা(বড়ভাঙ্গা), যাদুকাটা, চুনাই, দেওড়ভাগা, পেকুয়া, শুটকী, বৌলাই, বোগাপানি, ভীমখালী, সুনই, ধলাই, গোমাইগাঙ, জালিয়াছড়া, বাগরাগাং, বটেরগাঙ, বেমুনা, গোপলা, লংলা, দেরু, আমিরদীন, ভেড়ামোহনা, ষাটমা, লঙ্গু, ধামাই, বাগহাতা, বারনা।
পাথর কয়লা উত্তলন আর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে চা বাগান তৈরী এসব কারণে উপরে হয়েছে পাহাড় ধসে যাওয়ার ব্যবস্থা। তাই পানির পুনঃসঞ্চালিত ও সারা বছর পানি সরবরাহের ইকোসিস্টেম ধ্বংস করার কারণে দ্রুত নদ-নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হওয়া প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাই অনিবার্য খনন কর্মটি না করার কারণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে সিলেট অঞ্চলের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। স্রোতের তোড়ে নদীর পলিমাটি গিয়ে পড়ছে হাওরগুলোতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য জলাধার ছোট বড় বিল আর শাখা নদীগুলো।
প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমা নদীর ১১০ কিলোমিটারই সিলেটে অঞ্চলে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন গত দুই দশকে এই ১১০ কিলোমিটারের ৪০-৪৫ শতাংশ অংশে চর হয়েছে। যেখানে চর হয়নি, সেখানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। সুরমা এখন অনেকটাই মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুশিয়ারার ১২০ কিলোমিটার পড়েছে সিলেটে। এ নদীতে খুব বেশি চর না পড়লেও গভীরতা কমতে শুরু করেছে।
সিলেট নগরীর ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমায় হচ্ছে মতুন অত্যাচার। নগর সংলগ্ন মাত্র দশ কিলোমিটারের মধ্যে চারটি সেতও নদী ভরাটের একটা বড় কারণ। নগরীর বয়ে যাওয়া সবগুলো ছড়া প্রাকৃতিকভাবে উৎস থেকে গিয়ে পড়েছে সুরমা নদীতে। কালের পরিক্রমায় মানুস গ্রাস করেছে অধিকাংশ ছড়া। এসব উদ্ধার করতে যেয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে বদলে ফেলা ছড়ার প্রাকৃতিক রূপ। তাই স্বাভাবিক স্রোতধারা হচ্ছে বাঁধাগ্রস্থ। বড় শহরের আবাসন বিবেচনায় কোন ড্রেনেজ ব্যাবস্থা নেই। অপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে উন্নয়নের নামে সৃষ্টি করা হচ্ছে নতুন জঞ্জাল। অপরিকল্পিত নগরায়ন আর ভুমি/আবাসন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে ভরাট হয়েছে শহরের অসংখ্য জলাধার। ১৯৭৯ সালেও শাহজালাল উপশহর ছিল একটি হাওড়। এটা সরকারী উদ্যোগেই আবাসিক এলাকা হয়েছে। শামীমাবাদ, সুরমা আবাসিক এলাকা এসব নীচু ধানি জমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে। জনদুর্ভোগ জন্য দায়ী নিজেরাই। শহরের অধিকাংশ এলাকা আজ বন্যা কবলিত এর কারণ প্লাবন ভুমিতে আবাসন গড়ে তোলা।
পরিত্রাণের পথ কি ! পথ তো আছে। সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নদী ও নগর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দ্রুত একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। সমস্ত অপরিকল্পিত প্রকল্প বন্ধ করে নতুন আঙ্গিকে বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে।
লেখক: রাজনীতিক, সাবেক ছাত্রনেতা