২৬ সেপ্টেম্বরের অপূর্ণ প্রত্যাশা
ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
আমার লেখালেখির শুরুটা যে জমানায়, সোশ্যাল মিডিয়া তো দূরে থাক, কম্পিউটার-ই ছিল আকাশের চাঁদ। তখন আমরা হাতে লিখতাম, সেই পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দিতাম পত্রিকার অফিসে আর টাইপ সেট হলে আবার পত্রিকার অফিসে গিয়ে ফাইনাল প্রুফ দেখা। এ রকম সপ্তাহখানেকের প্রবল প্রচেষ্টায় অবশেষে একটা লেখা পাড়ার মোড়ের পত্রিকার দোকানে আলোর মুখ দেখতো। এখন সেই জমানা নেই। এখন মোবাইলে টাইপ করে মেসেঞ্জারে লেখা পাঠালে মুহূর্তেই তা অনলাইনে।
সেই যুগের আর এই যুগের লেখালেখির মাঝে ফারাক আছে আরও অনেক। সেই যুগে পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানার কোনো সুযোগ ছিল না। এই যুগের পাঠক চাইলেই লাইক আর কমেন্টের এক খোঁচায় তা পৌঁছে দিতে পারে লেখকের কাছেতো বটেই সাথে হাজারো মানুষের কাছেও। আর তারা তা করতে পারেন বলেই আমরা জানি তাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যারা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচকের পাশাপাশি প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার মাঝে যে ফারাকটুকু, সেটুকুও জানতে চান।আর সে রকম প্রেক্ষাপটেই এই লেখাটি।
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে। তাদের ওপর অর্পিত চ্যালেঞ্জটা বহুমাত্রিক। শুধু আমাদের ভবিষ্যৎটাকে ঠিক করে দিলেই হবে না, তাদের শুধরাতে হবে আমাদের পঙ্কিল অতীতটাকেও। আমাদের ভবিতব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটা নিয়ে লিখেছি অনেক। আজ একটু পেছন ফিরে তাকানো। আমাদের ঠিক নিকট অতীতে জাতি হিসেবে আমাদের অপরাধ অনেক। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধীদের আমাদের জাতীয় পতাকা শোভিত করেছি। জাতির পতাকা দিয়েছি জাতির জনকের হত্যাকারীদের গাড়িতে আর বাড়িতেও।
জাতির ইতিহাসকে শুদ্ধ করার কঠিন দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের প্রিয় বড় আপা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে তিনি দেশকে মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তি দিয়েছেন এই জাতিকে। বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধীদের সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে।
আইনের প্রসারিত হাতকে পঁচাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর এই দিনে খর্ব করেছিল খন্দকার মোশতাক। এই দিনেই জারি করা হয়েছিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি। আর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে খুনি মোশতাকের সেই অধ্যাদেশকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিল জিয়া সরকার ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই।
৯৬’-এ শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর মহান জাতীয় সংসদ ১২ নভেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল করে। আরও পরে ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালত জিয়া সরকারের ৫ম সংশোধনীটি অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।
নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিয়মিত আদালতে প্রচলিত আইনের আওতায় আনা হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যের আত্মস্বীকৃত খুনিদের। দণ্ডিত হলো ঘাতক, হৃদ্ধ হলো জাতি আর আমরাও প্রশান্তির ঢেকুর তুললাম – এই বুঝি শুদ্ধ হলো ইতিহাস। কিন্তু আসলে কি তাই? বিচার কি সত্যি-ই সম্পূর্ণ হয়েছে?
কোথাও তো দেখি না খুনি মোশতাক বা জিয়ার নাম বঙ্গবন্ধুর দণ্ডিত খুনিদের তালিকায়। নামতো নেই তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষি আর এমনি আরও নাম জানা-অজানা খুনির দোসর আর নেপথ্যের খুনিদের। প্রচলিত আইনে যদি স্বাভাবিক মৃত্যুতে খুনির বিচারের পথ রুদ্ধ হয়, তবে কেমন সে আইন?
শতবর্ষে যখন বঙ্গবন্ধু আর পঞ্চাশের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ যখন জনগণের আস্থায় তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়, তখন সেই ক্ষমতাসীন দলের কাছে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে নেপথ্যের খুনিদের চিহ্নিত করে প্রতীকী বিচার করা আর এর মাধ্যমে জাতির ইতিহাস আর ভবিষ্যৎকে শুদ্ধ করার দাবি করাটা কি খুব বেশি অযৌক্তিক?যে খুনি মোশতাক ৭৫’-এ আজকের এই দিনে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান তাতে সেঁটে দিয়েছিল সাংবিধানিক সিলমোহর – আজকের এই দিনে তাদের বিচারের অপূর্ণ প্রত্যাশাটা পূরণ কি আমাদের যৌক্তিক প্রত্যাশা হতে পারে না, তা সে কোভিড থাক আর নাই-ই থাক।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।