শাঁওলি মিত্রের শেষ ইচ্ছাপত্র
দিলীপ মজুমদার
চলে গেলেন শাঁওলি মিত্র।নাথবতী অনাথবতের’ শাঁওলি । ‘বিতত বিতংস’ , ‘পুতুলখেলা’ , ‘কথা অমৃতসমান’ ,’গ্যালিলিওর জীবন’ , ‘লঙ্কাদহনে’র শাঁওলি । তাঁকে শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রের কন্যা বলেই জানতাম । ভুল ভেঙে গেল ‘নাথবতী অনাথবৎ’ দেখে । নিজের পরিচয় নিজে তৈরি করে নিয়েছেন তিনি । স্বতন্ত্র স্বাধীন ।খ্যাতনামা দুই নর-নারীর কন্যা তিনি , জিনগত বৈশিষ্ট্য আছে , তবু তিনি স্বতন্ত্র সত্তা ।প্রচারবিমুখ , আত্মমগ্ন শাঁওলি মিত্র । তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে ফুটে উঠল সেই প্রচারবিমুখতা ।তিনি ইচ্ছাপত্রে লিখে ছিলেন তাঁকে যেন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাসপাতালে ভর্তি করা না হয় , চিকিৎসার নামে কষ্ট না দেওয়া হয় ; নিজের বাড়িতে শান্তিতে তিনি থাকতে পারেন যেন । অসুস্থ ছিলেন তিনি । অনুভব করছিলেন মৃত্যুর পদধ্বনি । আমরা অনেকেই করি । কিন্তু আহ্বান করতে পারি না মৃত্যুকে । কার লেখায় যেন পড়লাম , মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে শাঁওলি অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নিতে বলেছিলেন তাঁর মুখ থেকে । শাঁওলি হয়তো দেখেছিলেন মৃত্যুর মুখ , দু-একটা কথাও হয়তো বলেছিলেন তার সঙ্গে ।
তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয় নি । জানতে পারে নি কেউ । জানতে পারলো দাহকাজের পরে । এ রকম অন্ত্যেষ্টির নির্দেশ ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে । বাপকা বেটি তিনি । শম্ভু মিত্র ১৯৯৭ সালের ১৯ মে মৃত্যুবরণ করেন । তাঁর মৃত্যুর খবরও মানুষ জেনেছে দাহের পরে । সিরিটির শ্মশান থেকে ফিরে শাঁওলিই জানিয়েছিলেন সংবাদ মাধ্যমকে । শেষ ইচ্ছাপত্রে শম্ভু মিত্র লিখেছিলেন , ‘ মোটকথা আমি সামান্য মানুষ । জীবনের অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি । তাই মরবার পরেও আমার দেহটা তেমনি নীরবে , একটু ভদ্রতার সঙ্গে , সামান্য বেশে , বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে পুড়ে যেতে পারে ।মনে পড়ে অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের কথা । আশ্চর্য এক প্রহেলিকা তিনি । অভিনয় ছেড়ে দিয়েও অনেকদিন বেঁচেছিলেন । কিন্তু মানুষ তাঁকে দেখতে পায় নি । এমন কি মৃত্যুর পরে , শ্মশানেও ছিল সেই অন্তরাল । শত শত মানুষের ভিড় , মানুষের উৎসুক দৃষ্টি , কিন্তু তিনি অন্তরালবর্তিনী হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন অগ্নির কাছে ।
‘গানওয়ালা’ কবীর সুমনের শেষ ইচ্ছাপত্র আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন । নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেবার আবেদন ছিল তাঁর । তিনি লিখেছিলেন , ‘আমার মৃতদেহ যেন দান করা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে । কোনও স্মরণসভা , শোকসভা , প্রার্থনাসভা যেন না হয় । আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি , গান , রচনা , স্বরলিপি , রেকডিং , হার্ডডিস্ক , পেনড্রাইভ , লেখার খাতা , প্রিন্ট আউট যেন কলকাতা পুরসভার গাড়ি ডেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় , সেগুলি ধ্বংস করা হয় । আমার ব্যবহার করা সব যন্ত্র , বাজনা , সরঞ্জাম যেন ধ্বংস করা হয় । ’ জানি না কবীর সুমনের এই শেষ ইচ্ছা পালিত হবে কি না । তা যদি হয় , তাহলে বাংলা গানের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে ।নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেবার ইচ্ছা পৃথিবীর বেশ কিছু মানুষ পোষণ করতেন । যেমন জার্মানভাষী চেক ঔপন্যাসিক ফ্রানজ কাফকা । যাঁর ‘মেটামরফোসিস’ আলোড়নসৃষ্টিকারী রচনা । কাফকার শেষ ইচ্ছাপত্রের সঙ্গে কবির সুমনের ইচ্ছাপত্রের অনেক মিল আছে । অমিল একটাই । তাঁর লেখা বা চিঠিপত্র , যা অন্যদের কাছে আছে , সেগুলোও তিনি পুড়িয়ে ফেলতে বলেছেন । কাফকা বলছেন , ‘ My last request .. Everything I leave behind me .. in the way of notebokks , manuscripts , letters and my own and other people’s , sketches and so on , is to be burned and to the last page, as well as all writing of mine or notes which either you may have or other people , from whom you are to beg them in my name . Letters which are not handed over to you should at least be faithfully burned by those who have them . ’ এ অনুরোধ কাফকা করেছিলেন তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে । কিন্তু ব্রড সে অনুরোধ রক্ষা করেন নি ।
রুশ লেখক নিকোলাই গোগল লেখেন ‘ডেড সোল’ । পরবর্তীকালে উপন্যাসটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডও তিনি লিখেছিলেন । কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল পরবর্তী খণ্ডগুলির লেখার মান তেমন উন্নত নয় । ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন গোগলের মতে ‘ঈশ্বরের অনিচ্ছার কারণে এ গুলির মান উন্নত হয় নি । ’ তাই এগুলি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি ।জর্জ বার্নাড শ তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে তাঁর মৃত্যুর পরে কোন ধর্মীয় আচার পালন করতে নিষেধ করেছিলেন । নিষেধ করেছিলেন প্রচলিত শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান । তাঁর সমাধিক্ষেত্রে কোন প্রতীক স্থাপন করতেও নিষেধ ছিল তাঁর । চার্লস ডিকেন্স তাঁর শোকসভার ব্যাপারে কোন নিষেধ করেন নি বটে , তবে বলেছিলেন যাঁরা শোকসভায় আসবেন তাঁদের কালো বস্ত্র বা স্কার্ফ পরার দরকার নেই ।আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের শেষ ইচ্ছাপত্র বড় বিচিত্র।তিনি বলেছেন , ‘আমার মৃত্যুযাত্রায় আমার কফিনের পাশে থাকবে সেরা ডাক্তাররা ,তার থেকে এটা প্রমাণিত হবে যে মৃত্যুকে রোধ করার শক্তি ডাক্তারদের নেই।আমার মৃত্যুযাত্রায় রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে আমার ধন-সম্পদ,এটা প্রমাণ করার জন্য যে ধনসম্পদ একান্তভাবে পার্থিব বস্তু এবং মৃত্যুর পরে মানুষ তা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না।আমার শবদেহের থেকে আমার হাতদুটো ঝুলিয়ে দিতে হবে,এটা প্রমাণ করার জন্য যে মানুষ পৃথিবীতে যেমন খালি হাতে আসে ,তেমনি খালি হাতে যায়।
লেখক: ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।