বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ
দিলীপ মজুমদার
ভাষা মরণশীল । উদ্ভিদ ও প্রাণীর মতো মৃত্যু হয় ভাষারও । ব্রিটিশ ভাষাবিদ ডেভিড স্ট্যানলি বলেছেন প্রতি দু সপ্তাহে একটি করে ভাষা মৃত্যু বরণ করছে পৃথিবীতে । ভাষার মৃত্যুতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হান্স জুরগেন স্যাশে । এখন পৃথিবীতে ৬/৭ হাজার ভাষা আছে । আগামী শতকে সেটা অর্ধেক হয়ে যাবে । ভারতে ৭০০-র মতো ভাষা ছিল । কিন্তু গিসারি , ওয়াডারি , গোল্লা , হলদি , মারচি , পাইরি , কাটাগির মতো ৬০০টি ভাষা মরে ভূত হয়ে গেছে । যে সব ভাষা মরে যায় , তাদের আমরা মৃত ভাষা বলি । যেমন আমাদের সংস্কৃত ভাষা । দেবতারা আছেন কি না , তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন কি না , আমরা জানি না । কিন্তু সংস্কৃতকে ‘দেবভাষা’ বলার রেওয়াজ আছে । দেব-দ্বিজে ভক্তিমান বিজেপি সরকার সংস্কৃত ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন । কিছুদিন কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, যেমন আই সি ইউতে রোগীদের কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারবেন না বাঁচাতে । ভাষা যেন ভাইরাস । ভাইরাস নিজে মৃত কিন্তু প্রাণীর শরীরে ঢুকে জীবন্ত হয় । ভাষাও তেমনি মানুষের শরীরে ঢুকে জীবন্ত হয়ে ওঠে । মানুষ যদি সেই ভাষায় কথা না বলে , লেখা-জোখা না করে , তাহলে তার মৃত্যু ঠেকানো অসম্ভব ।
আমাদের বাংলা ভাষার শরীরে ধীরে ধীরে মৃত্যুর লক্ষণ ফুটে উঠছে । বাঙালি ছেলে-মেয়ের কাছে বাংলা ব্রাত্য হয়ে উঠছে । কেন ? জীবিকার অজুহাত দেওয়া যেতে পারে । ১৯৮৬ সালে তদানীন্তন সরকারের ভাষানীতি ভুল বার্তা দিয়েছিল । তারই ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গজিয়ে উঠতে থাকে । জীবিকার অজুহাতে অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দিকে ছুটে চললেন । সেই সঙ্গে চলতে থাকে হিন্দির আগ্রাসন কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে । কলে-কারখানায় , অফিসে-আদালতে , ব্যাঙ্কে-রেলে হিন্দিভাষী মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে , দাপটে চলে হিন্দি চলচ্চিত্র । বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বাংলা ভাষার খিচুড়ি বর্ধিত হয় । বাঙালি লেখদের লেখাতেও দেখি সেই খিচুড়ি ।এ কথা ঠিক যে বিদেশি শব্দ গ্রহণ করে ভাযা সমৃদ্ধ হয় । যে ভাষা শক্তিমান সে ভাষা বিদেশি শব্দ আত্মীকরণ করে নিতে পারে । বাংলা ভাষা বহু আরবি-ফারসি-ইংরেজি শব্দকে নিজের করে নিয়েছে । ভাষাতাত্ত্বিকদের বই খুললে তার প্রমাণ পাওয়া যায় । কিন্তু বিদেশি শব্দ গ্রহণেরও একটা সীমা আছে । আমরা যদি বাংলা ভাষার মধ্যে ক্রমাগত বিদেশি শব্দ মিশিয়ে দিতে থাকি , তাহলে বাংলা ভাযার প্রাণবায়ু ক্ষীণ হতে বাধ্য । ফ্ল্যাট কালচারও বাংলা ভাষার পক্ষে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে । সে সব ফ্ল্যাটে কথোপকথনের মাধ্যম হয় হিন্দি , নতুবা ইংরেজি । ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির বিজ্ঞাপনগুলিতে বাংলা ভাষার স্থান হয় না । একদা লেখক সুনীল গাঙ্গুলী ও তাঁর অনুগামীরা এ ব্যাপারে বিদ্রোহী হয়েছিলেন । কিন্তু সে বিদ্রোহের শেষরক্ষা হয় নি । এখনও বিলবোর্ডে ইংরেজির প্রাধান্য ।
অন্যান্য রাজ্যের বহু মানুষ জীবিকার সূত্রে এই রাজ্যে বসবাস করেন । তাঁদের বাংলা লেখা ও বলা বাধ্যতামূলক নয় । ফলে তাঁদের ভাষা প্রভাবিত করে বাঙালিকে । স্মার্টফোনের স্ক্রিনে বন্দি হয় বাংলা ভাষার আবেগ । ফেসবুকে চলে বাংলা-হিন্দি-ইংরেজিমিশ্রিত এক কিম্ভূতকিমাকার চ্যাটিং । বই পড়ার অভ্যেস এমনিতে কমে গেছে , সেখানে বাংলা বইএর হাল তো অনুমান করা যায় । ঘটা করে বইমেলা হয় , প্রচুর বিক্রিবাটা হয়, কিন্তু বাংলা বই কত বিক্রি হয় আমরা তার হিসেব পাই না । বাংলায় যদি কথা না বলি , বাংলায় যদি না লিখি , বাংলা বই যদি না কিনি , বাংলা শুনতে যদি অনীহা দেখাই তাহলে বাংলা বাঁচে কি করে ?
অথচ এমনটা হবার কথা নয় ।
সমগ্র বিশ্বে প্রায় ২৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা । এর মধ্যে ১৬ কোটি বাংলাদেশে , ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-অসম-ত্রিপুরায় আছেন ১২ কোটি বাঙালি । মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বের ভাষা তালিকায় বাংলার স্থান পঞ্চম , আর বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এর স্থান সপ্তম ।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাস করেন প্রায় ২ কোটি মানুষ । প্রশংসনীয় এঁদের উদ্যম । এাঁরা বাংলাদেশি কমিউনিটি তৈরি করে চালু করেছেন বাংলা স্কুল । কানাডায় সুব্রতকুমার দাশ ও তাঁর সহযোগীরা বর্তমান প্রজন্মকে ইংরেজির মাধ্যমে শেখাচ্ছেন বাংলা । ৫০/৬০টি অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণে বাংলা ভাষার পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন । ইউরোপের ৭ / ৮টি টিভি চ্যানেলে বাংলায় খবর পরিবেশিত হয় । প্রায় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়া গবেষণাকেন্দ্রে বাংলাভাষার চর্চা ও গবেষণা হয় । এশিয়ার মধ্যে জাপান , কোরিয়া , মালয়েশিয়া , সিঙ্গাপুরে বাংলা ভাষার চর্চা হয় । ইউনিভার্সিটি অব লণ্ডনের প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগের অধীনে বাংলা ভাষাচর্চা ও গবেষণা অব্যাহত আছে ।ভাষার প্রসার ও শ্রীবৃদ্ধিতে থাকে লেখকদের অবদান । বাংলা ভাষা্য আছে উন্নতমানের সাহিত্য । দুশো বছরের সময়সীমার মধ্যে বাংলা গদ্যভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে । বিদ্যাসাগর , বঙ্কিমচন্দ্র , রবীন্দ্রনাথ , শরৎচন্দ্র , তারাশংকর , মানিক , বিভূতিভূষণ , জীবনানন্দ , সুকান্ত , আশাপূর্ণা , মহাশ্বেতা , সুনীল , শক্তি প্রমুখের মতো শক্তিমান লেখকরা বাংলা ভাষার অলংকার । বাংলা ভাষায় অসংখ্য ছোট পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে । জাহিরুল হাসানের ‘সাহিত্যের ইয়ারবুক’এর পাতা ওল্টালেই তা বোঝা যাবে ।
তবু কেন সেই সমৃদ্ধ ভাষার নাভিশ্বাস ?
এ কথা ঠিক যে কাজের ভাষা না হলে এ যুগে ভাষার প্রাণবায়ু ক্ষীণ হয়ে যায় । বাংলাকে কাজের ভাষা করে তোলার ব্যাপারে লাগাতার উদ্যোগ দেখা যায় নি । পরিভাষার ব্যাপারেও অভাব আছে উদ্যোগের । এ সবের সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা । উনিশ শতকে এই অর্থনীতির তাগিদে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলায় পাঠ্যবই রচনার আয়োজন করেছিলেন । কালক্রমে আমাদের রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যায় । তার উপর জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনের জেরে একের পর এক কল-কারখানা হয় বন্ধ হয়ে যায় , নতুবা পাড়ি দেয় অন্য রাজ্যে । মন্দার ঢেউ বইতে থাকে শিল্প ও বাণিজ্যের জগতে । অর্থনীতির এই অবক্ষয় বাংলা ভাষাকে ‘অ-কেজো’ ভাষায় পরিণত করে । তাই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের মনে তাঁদের সন্তান-সন্ততির জীবিকার প্রশ্নে জমতে থাকে আশঙ্কার মেঘ । বিশ্বায়ন আবার জোর ধাক্কা দেয় ।আমাদের প্রশাসকদেরও সীমাবদ্ধতা আছে । প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলার সার্বিক প্রচলন এখনও অপেক্ষিত । বাংলায় চিঠি লিখলে উত্তর আসে ইংরেজিতে । ব্যবসায়িক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ডে বাংলার অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি তাঁরা , ভিন রাজ্যের অধিবাসীদের বাংলা ভাষা শিক্ষায় উৎসাহিত করতে পারেন নি , চলচ্চিত্র-ফেসবুক-টিভির হাত ধরে বাংলা ভাষার যে ধারাবাহিক অবক্ষয় হচ্ছে তাকে প্রতিরোধ করতে পারেন নি , বাংলা বইএর প্রকাশনাকে যথেষ্ট মদত দিতে পারেন নি । জানি না , এর পরে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘এক দেশ এক ভাষা’ নীতিকে প্রতিহত করতে পারবেন কি না । যে বাংলাদেশ মাতৃভাষা বাংলার জন্য কঠিন কঠোর লড়াই করেছিল , প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বহাল রেখেছিল , বিদেশে বাংলাভাষী কমিউনিটি চালু করেছিল , সেই বাংলাদেশেও বাংলা ভাষা ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছে ।
[লেখক ফেলোশিপপ্রাপ্ত সিনিয়র গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট]