কলিজায় কাঁপন! কলিজায় নাচন!
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
একদিকে সিঙ্গাপুরের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হচ্ছে আগামী মাসের শেষেই আমরা সম্ভবত মুক্তি পেতে যাচ্ছি কোভিড-১৯ নামক দানবটির খপ্পর থেকে। আশাবাদী হচ্ছি অনেকেই। আবার অজানা শঙ্কায়ও দুরু-দুরুও অনেকেরই বুক। আসলেই কি তাই? প্রতিদিনই যখন দেশে আরেকটু করে বাড়ছে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা, তখন প্রশ্ন জাগাটা খুবই স্বাভাবিক, আমরা কি পৌঁছে গেছি পাহাড়ের চূড়ায় নাকি আরো দেখা বাকি আছে আমাদের?
কোভিড-১৯ নামক যে দানবটি হানা দিয়েছে পৃথিবীর ২১০টি দেশে, এক দিন না এক দিন তার তো বাংলাদেশে আসার কথাই ছিল। তাকে যখন ঠেকাতে পারেনি পৃথিবীতে যারা তাবত্ ক্ষমতাধর আর জ্ঞানে-বিজ্ঞানে যারা উত্কর্ষের চূড়ায়, তখন আমাদের কি শক্তি তাকে এড়াই? এদিক দিয়ে আমাদের অর্জন যে প্রশংসনীয় সেটা মানতেই হবে। এ দানবকে আমরা ঠেকিয়ে রেখেছিলাম একটি-দুইটি নয়, গুনে-গুনে ৬৫টি দিন। কোভিডে আক্রান্ত হবার যে ‘রোল অব অনার’, তাতে আমাদের অবস্থান চার কিংবা পাঁচ নয়, একেবারে ১০৫-এ। এরপর যা হবার তাই হয়েছে। কোভিড এসেছে দুয়ারে। ইতালি প্রবাসীদের কেন দেশে ফিরিয়ে আনা হলো, কেন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে না রেখে পাঠানো হলো হোম কোয়ারেন্টাইনে, এমনি সব প্রশ্ন আসলে অবান্তর। কোভিড আসতই। ৮ মার্চ না হলে, ১৮ কিংবা ২৮-এ, বড়োজোর না হয় আর দুই-চারটি দিন আগে কিংবা পরে।
প্রশ্ন উঠেছে ভেন্টিলেটর নেই কেন? কেন নেই জেলায়-জেলায় পিসিআর মেশিন? এমনটা তো হবারই ছিল। এমনটাই তো হয়েছে দেশে-দেশে। ১ জানুয়ারি যখন ২০২০-কে বরণের আনন্দে মেতেছিলাম দেশে-দেশে আমরা সবাই, কারো মাথাতেই তো তখন ঘুনাক্ষরেও ছিল না উহানের চিন্তা। জাপান সরকারও তো তাই এখন অসহায়ভাবে স্বীকার করছে, তারা চিন্তাই করতে পারেনি এমনি কোনো এক সক্রামক রোগ তাদের অমন গর্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এমনিভাবে কুপোকাত করে দিবে! আর না হয় বাদ-ই দিলাম ইউরোপ আর আমেরিকার কথা। ওখানে তো ভেন্টিলেটরে তোলার আগে দাঁড়িপাল্লায় মাপা হচ্ছে বাঁচার আশা কতখানি। লন্ডনে যখন শ্বাসকষ্ট না হলে কোভিড রোগীদের হাসপাতালের ছায়া মাড়ানোরও সুযোগ নেই, আর হোয়াইট হাউজের সামনে যখন পিপিইর দাবিতে নার্সদের বিক্ষোভ, তখন তো মনে হতেই পারে যে আমরা হয় তো ভালোই আছি।
ভালো আছি কি না জানি না, তবে এটুকু জানি অনেকের চেয়ে ভালো আছি। আর জানি খারাপ থাকতে পারতাম অনেক বেশি। তার পরও মনের কোনায় কোথায় যেন একটুখানি খেদ! যারা বলেন আসলে এদেশে আক্রান্ত হয়েছেন লাখে-লাখে মানুষ আর মারা যাচ্ছেন হাজারে-হাজারে, তাদের কথাকে আমি দুই পয়সার পাত্তাও দেই না। কারণ করোনাকালে রোগীর ঢেউ আর মৃত্যুর মিছিল লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। পারেনি এ পৃথিবীতে কেউ-ই। বিশ্বাস না হলে তাকিয়ে দেখুন ইকুয়েডরের দিকে কিংবা দেখুন ইতালি বা নিউ ইয়র্কের অবস্থা। মৃতদেহ সত্কারের অভাবে যখন লাশ পড়ে আছে ইকুয়েডরের রাস্তায়-রাস্তায়, ইতালিতে তখন কফিনের অভাবে হাসপাতালে দেখা দিচ্ছে লাশ-জট আর নিউ ইয়র্কের ব্যস্ততা তখন গণকবর খোঁড়ায়। আর যখন কেউ আমাকে যুক্তি দেন ভেন্টিলেটর বা পিসিআর নাই কেন, সবিনয়ে বলি, পাবেন কোথায়? ট্রাম্প সাহেব তো এক এন-৯৫ মাস্কই দেশ থেকে রপ্তানি করতে দিচ্ছেন না। পারেন তো শিরায় দিচ্ছেন জীবাণুনাশকের ইনজেকশন। এই যখন পরিস্থিতি তখন আপনাকে ভেন্টিলেটর আর পিসিআর মেশিনটা বিক্রি করছে কে? আর যদি মেশিন জোগাড়ও হয় চালাবার লোক আছে? এজন্য তো চাই দক্ষ জনবল। তৈরি কি হয় তা এক দিনে? এক মাসে পিসিআর ল্যাব বাড়ানো যায় ১ থেকে ২৭-এ, কিন্তু বাড়ানো যায় না দক্ষ জনবল।
কাজেই আমাদের এখন যা প্রয়োজন তাহলো আমাদের যেন ভেন্টিলেটরের রাস্তা না ধরতে হয় সেই পথে হাঁটা। আমাদের উচিত যে কোনো মূল্যে ঘরে বসে থাকা। কথায়-কথায় আমরা করোনাকালকে ’৭১-এর সঙ্গে তুলনা করি। বাংলা ভাষায় সংযোজিত হয়েছে নতুন শব্দ ‘করোনা যোদ্ধা’। আমার তো মনে হয় ’৭১-এ যুদ্ধটা ছিল অনেক বেশি কঠিন। আজকের যুদ্ধটা তার চেয়ে ঢেড় বেশি সোজা। শুধু ঘরে বসেই যে কেউ হয়ে যেতে পারেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক করোনা যোদ্ধা। যারা সিঙ্গাপুরের রিপোর্ট দেখে দ্বিগুণ উত্সাহে আগামীকাল ইফতার কিনতে দোকানে ছুটবেন কিংবা আড্ডা জমাবেন মোড়ের মুদি অথবা চায়ের দোকানে, তাদের মনে রাখতে হবে সিঙ্গাপুরের ঐ বিশেষজ্ঞরা গনক কিংবা জ্যোতিষী নন। তারা কিছু তথ্য-উপাত্ত আর ডাটা বিশ্লেষণ করে এ ধরনের প্রেডিকশন দেন। বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা একে বলি ম্যাথামেটিকাল বা গাণিতিক মডেল। যেই মুহূর্তে আমরা পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে লাখো গার্মেন্টস শ্রমিকের সমাবেশ ঘটিয়েছি, ঠিক তখনই এই মডেলটি ‘নাল অ্যান্ড ভয়েড’ হয়ে গেছে। এসব মডেল যারা তৈরি করেছিলেন তাদের মাথায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-পাটুরিয়া ছিল না।
চলমান বাস্তবতায় আমাদের এক দিন লকডাউন তুলে নিতে হবে এটাই বাস্তবতা। আমেরিকায়তো চুল কাটতে নাপিতের দোকানে যাবার দাবিতে বিক্ষোভ হতে দেখছি। বিক্ষোভ করছে মার্কিনিরা বন্দুক হাতে লকডাউন তুলে নেওয়ার দাবিতে এমনটিও এখন আর গাঁজাখোরি গল্প নয়। সেই তুলনায় আমরা তো ভালোই আছি। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের পাবলিকেশনের ধুয়া তুলে যারা বলেছিল এদেশে এরই মধ্যে মারা যাবে লাখো মানুষ কিংবা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দোহাই দিয়ে যারা আশায় জাল বুনছিলেন যে এদেশে দুর্ভিক্ষ এই হলো বলে, তাদের আশায়ও তো গুড়েবালি।
কিন্তু অর্থনীতির চাকাকে তো কোনো একটা পর্যায়ে সচল করতেই হবে। একটা কার্যকর ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত এই পৃথিবীটা তো আর ২০১৯-এ ফিরে যাবে না। কাজেই যাই করি আর নাই করি, বাজারই করি কিংবা সচল করি গার্মেন্টসের মেশিনগুলো, অবশ্যই তো তা করতে হবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে। হারাম শরীফ কিংবা মসজিদে নববী এই যে খুলে দেওয়া হচ্ছে সেখানেও কিন্তু বজায় থাকবে এই বাধ্যবাধকতা। টিভির পর্দায় নিজেই তো দেখেছি সীমিত পরিসরে কলকারখানা চালু করার আগে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে এ ধরনের সব প্রতিশ্রুতি দিতে। কিন্তু বাস্তবে তো ঘটতে দেখছি ঠিক উলটোটা। ঐ টিভির পর্দায়ই তো দেখছি কলকারখানার ভেতরে যাওবা কিছু, ঢোকার আর বের হবার বেলায় তো ওসব নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কাই নেই।
আমি এসব দেখি আর ভাবি অর্থনীতির চাকাকে চালু করার এই যে উদ্যোগ, আমাদের অপরিণামদর্শিতায় তা না আবার ভেস্তে যায়। তখন তো আমরা আবার সেই সরকারকেই দুষব। সরকারের পক্ষে কখনো কি সম্ভব শিল্পাঞ্চল পুলিশ পাঠিয়ে শিল্পেশিল্পে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা? কোনো দেশে কোনো সরকার কি তা পেরেছে না পারবে? আমাদের কারখানায় কিংবা রেস্টুরেন্টে, আমাদের কাঁচাবাজারে অথবা আমাদের সুপার শপে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরকেই এবং তা আমাদেরই স্বার্থে। নচেত্ আবার যদি পুরোপুরি লকডাউনে যেতে হয়, তবে তা করতে হবে অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মূল্যে আর অনেক বেশি সময়ের জন্য।
করোনাকালের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হচ্ছে বাঙালির সৃজনশীলতার ব্যাপক উন্মেষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার হাজারো উদাহরণ উড়ে-ভেসে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেদিন ফেসবুকে দেখলাম ২০৫০ সালের একটি দৃশ্যপট। ২০২০ সালে কোনো একটি জাতি নাকি শুধু বাজার করতে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। টিভিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-পাটুরিয়া দেখি আর কলিজায় ‘কাঁপন’ ধরে। কলিজায় একদমই ‘নাচন’ ধরে না পর্যায়ক্রমে লকডাউন তুলে নেওয়ার ইঙ্গিতে। ‘জীবনকে’ তো ‘যাপন’ করতেই হবে, কিন্তু ‘জীবন-যাপন’ যেন ‘জীবনকে’ ছাপিয়ে না যায়। সরকারের কাছে যে ওয়াদা করেছিলাম, যে ওয়াদা করে বাজারে এসেছিলাম ঘর থেকে, সেটা আমাদের রক্ষা করতে হবে আমাদের নিজ দায়িত্বে এবং নিজ স্বার্থেই। নচেত্ বিপদ ঘটতেই পারে।
লেখক :চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ